বাসর রাতে নববধুর বুকের দাগটা দেখে আৎকে উঠলাম। ঠিক মাঝখানটায়। মাঝ বারবার বললে ভুল হবে। একটু উপরে। যেখান থেকে শরমের এলাকা শুরু , ঠিক সেখানে। অর্থাৎ, কামিজ বা ব্লাউজের গলা যদি স্বাভাবিক হয় তাহলে দেখা যাবে না। আর যদি একটু বড়, ঢিলাঢালা হয় বা বেখায়লীতে জামা ব্লাউজ একটু নিচে নেমে আসে তাহলে স্পষ্ট দেখা যায়। কন্যা দেখা , বিয়ে সম্পন্ন হয়ে ওলিমার অনুষ্টানের পর বাসর ঘর পর্যন্ত আসার দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাঝে একবারও চোখে পড়েনি। কি আশ্চর্য ব্যাপার ! অথচ এখন ঘোমটা সরিয়ে থুতনি ধরে লাজে রাঙ্গা মুখ উপরে তুলে ধরতেই চোখে পড়ল দাগটা। ইংরেজি বড় হাতের এম অক্ষর। ব্লাউজের বাহিরে অর্ধেক আর বাকি অর্ধেক ব্লাউজের নিচে ঢাকা পড়ে আছে।
আমার কপালে এমন বউ জুটবে ভাবাই যায় না। ছোট কাল থেক মা বলতেন সৎচরিত্রের জন্য সতী সাধ্বী আর চরিত্রহীনের জন্য চরিত্রহীনা স্ত্রী মিলে। মায়ের কথাকে অক্ষর জ্ঞান করে কখনও চরিত্রের মাঝে কলঙ্ক লেপন হতে দেইনি। অথচ আমার কপালের এই অবস্থা ? যতটুকু লক্ষ করেছি লোহা জাতীয় কোনো কিছু পুড়ে “এম “ অক্ষর লেখা হয়েছে। কি ভয়ঙ্কর ! তার মানে কারও ভালোবাসার নিদর্শন হিসাবে এমনটি করা ? গ্রামের অল্প শিক্ষিত ছেলেদের হাতে এমন দাগ দেখেছি। সিগারেট দিয়ে পুড়ে, ব্লেড দিয়ে কেটে প্রেমিকার নাম লিখে অথবা প্রতিকী চিহ্ন আঁকে। রুমাইসা শিক্ষিত মেয়ে। সে এমন করবে মানা যায় না। তার বাবা মানে আমার শশুড় প্রাক্তন চেয়ারম্যান। সবাই মোটামুটি শিক্ষিত। বলা যয় কুসংস্কার মুক্ত আধুনিক পরিবার। এমন পরিবারে বেড়ে উঠা কোনো একজন সদস্য বখে যাওয়া মানুষের আচরণ করবে এ কেমন কথা।
শুরুর দিকে এই বিয়েতে আমি রাজি ছিলাম না। আমার সিদ্ধান্ত ছিলো , শিক্ষকের মেয়ে অথবা আমার ছাত্রীকে বিয়ে করবো না। কিন্তু মায়ের পছন্দ, তাই শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছি। আমি যা কিছু করি সব মায়ের জন্য করি। মা খুব দুঃখী ও সংগ্রামী মহিলা। বিয়ের তিন বছরের মাথায় মাকে রেখে বাবা নিরুদ্দেশ হন। বাবার জন্য মা অধীর আগ্রহে দাদার বাড়িতে অপেক্ষা করেন। তখন আমার বয়স দুই। অপেক্ষা করেন দীর্ঘ পাঁচ বছর। ততদিনে সবাই ধরে নিয়েছিল বাবা মারা গিয়েছেন। বাবা মারা যাননি। ফিরলেন পাঁচ বছর পর। তিনি একা ফিরেননি, সাথে ছিল তার দ্বিতীয় স্ত্রী আর এক শিশু কন্যা।
মা খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। দাদার বাড়ি আর থাকেন নি। চলে আসেন নানার বাড়ি। আজ ত্রিশ বছর হতে চলল, জীবনের সাধ আহ্লাদ সব কিছু জলাঞ্জলি দিলেন মায়ের ভাষায় “আমার চাঁদ মুখের” পানে তাকিয়ে। তিনি সংগ্রাম করে গিয়েছেন নীরবে,মুখ বুজে , কোনো অভিযোগ ছাড়া। কিন্ডার গার্ডেন স্কুলে স্বল্প বেতনে শিক্ষকতা আর মানুষের বাড়ি বাড়ি যেয়ে টিউশন করেছেন। এই মায়ের কথা কি আমি উপেক্ষা করতে পারি ?
মাকে বলেছি আমার ছাত্রীকে বিয়ে করবো না। মা বুঝিয়েছেন। বলেছেন “ তকদিরের বিষয়ে নিজে থেকে সিদ্ধান্ত নিলে আল্লাহ বেজার হন। “
তকদিরের সিদ্ধান্ত অবশেষে প্রভূর হাতে ছেড়ে দিয়েছিলাম। এখন দেখি এই অবস্থা।
ছয় তলার নিজস্ব আধুনিক ফ্ল্যাটে সাজানো বাসর ঘর। তাজা ফুলের সামিয়ানা, সাদা চাদরের ঢাকা দামি পালঙ্ক ,ঘোমটা টেনে এক কোণে বসে থাকা পদ্ম ফুলের মত টকটকে ফর্সা অতি রূপবতি কন্যা আর আমার এক জীবনের সাজানো স্বপ্ন, সব কিছুকেই যেন প্রতারণা মনে হচ্ছে। অথচ কত কষ্ট করেই না নিজেকে আমি মেয়েদের সংস্পর্শ থেকে দূরে রেখেছি। পালিয়ে বেড়িয়েছি।
রুমাইসা আমার ছাত্রী। মাত্র কয়েক দিনের। সব কিছু এখন আর পরিষ্কার মনেও নেই। ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয়ে তাদের বাড়িতে লজিং ছিলাম। আমাদের বাড়ি থেকে কলেজ অনেক দূরে ছিল। রুমাইসা তখন ক্লাস এইটের ছাত্রী। সদ্য ফোটা পদ্ম ফুল। লম্বা ছিপছিপে গোধুলী বর্ণের লালচে ত্বক আর খাঁজ কাটা চেহারায় কঠিন মায়ার ছাপ। প্রথম দিনই সিদ্ধান্ত নিলাম যত দ্রুত সম্ভব চেয়াম্যান বাড়ি ত্যাগ করতে হবে। না হয় রূপের অনলে কখন যে কিভাবে পুড়ে ছারখার হয়ে যাব নিজেই টের পাবো না। আমি যে পথিক যাযাবর ! মায়ের জন্য আমাকে হাঁটতে হবে বহু দূর। এখানে অসময়ে আমাকে থামলে চলবে না। মা যে বড় দুঃখী !
জীবনের কাছে একবার হেরে যাওয়া মাকে আমি দ্বিতীয় বার হারতে দিতে পারি না। নিজে জিতে মাকে জিতিয়ে দিতে হবেই।
খুব পেরেশানিতে দিন পার করছিলাম। আমাকে যে দ্রুত চলে যেতে হবে। কিন্তু সহজে কোথাও জায়গীর পাচ্ছিলাম না। মেসে থেকে যে পড়বো সেই উপায়ও নাই। মায়ের স্বল্প কটি টাকায় খাওয়া পড়াই চলে না মেসের খরচ কেমনে হবে।
ঠিক তখনই ঘটনাটি ঘটে। বইয়ের মাঝে রুমাইসার প্রেম পত্র পাই। সুন্দর করে সে একটি লাইনই লিখেছিল “ আপনাকে খুব ভালো লাগে। এই ভালো লাগা মৃত্যুর চেয়ে ভয়ঙ্কর।”
কথায় আছে “যেখানে বাঘের ভয় সেখান সন্ধ্যা হয়”। যেই আমি ছিলাম পলায়নপর, সেই আমাকে রুমাইসার চিঠি দ্রুত পালাতে সাহায্য করেছিল। চিঠি পেয়ে সেই যে চেয়ারম্যান বাড়ি ত্যাগ করেছি আর কোনো দিন ঐ মুখো হইনি।
জীবন তো আর থেমে থাকে না। সংগ্রামী মায়ের সংগ্রামী ছেলে এক সময় বিশাল বিজয় ছিনিয়ে আনে।বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহ থেকে ভেটেনারী ডিগ্রি অর্জন করে উপজেলা ভেটেনারী সার্জন হিসাবে সরকারী কর্মকর্তার পদ অলংকৃত করে। হ্যা আমি এখন প্রথম শ্রেনীর কর্মকর্তা। যে রুমাইসা আতঙ্কিত ছিল চেয়ারম্যান সাহেব জানতে পারলে আমার কল্লা কেটে ফেলবেন এখন আমি সেই রুমাইসার উপযুক্ত পাত্র।
এতো কল্পনা, এতো স্বপ্ন কই গেলো ? একটি দাগ আমার জীবন তছনছ করে দিলো। কি করবো ? কি করা উচিত কিছুই ভাবতে পারছি না। ন কতক্ষন থ মেরে বসে আছি জানি না,রুমাইসার তাগাদায় এক সময় খাটের এক পার্শ্বে শুয়ে নির্ঘুম রাত কাটালাম। কাউকে কিছু বললাম না। আপাতত সিদ্ধান্ত নিলাম নীরব থাকার। দেখি কি হয়।
রুমাইসা কি ভেবেছিল জানি না। তবে পনেরতম দিনে সে আজগুবি একটি গল্প শুনায়। তখনও সে আমাকে আপনি করে সম্বোধন করছিল। কারন আসলে আমি একটা ঘোরের মাঝে দিনাতিপাত করছিলাম। তার সাথে স্বাভাবিক হতে পারছিলাম না।
:আমাকে আপনার পছন্দ হয় নি ?
: হ্যা হ্যা পছন্দ না হওয়ার কি আছে ? আমি আমতা আমতা করে উত্তর দেই।
: তাহলে আমার সাথে এমন আচরণ কেনো করছেন ?
: কই ? আমি তো ঠিক আছি। তুমি কি কোনো সমস্যা বোধ করছো ?
: শুনুন, আমি বাচ্চা মেয়ে না। সব বুঝি। যদি মন থেকে পছন্দ না করে থাকেন তবে বলুন আমি নিজের উপর দোষ নিয়ে নীরবে সরে পরবো ; যেভাবে আপনি আমাদের বাড়ি থেকে পালিয়ে ছিলেন।
: না না তা হবে কেন ?
: তাহলে ?
: আসলে আমার শরীরটা মনে হয় ঠিক নেই।
: আপনার সব ঠিক আছে। ধৈর্য ধরে আমার একটি গল্প শুনুন।
“আপনাকে প্রেম পত্র দিয়েছিলাম সহ্য করতে না পেরে। একজনকে ভালো লাগলে আর তাকে পাওয়ার সম্ভাবনা না থাকলে যে কি পরিমান কষ্ট হয় তা কাউকে বুঝানো সম্ভব নয়। এই যন্ত্রনা বেশি নাকি শারীরিক যন্ত্রনা বেশি তা বুঝার জন্য আমি কিছু কাজ করি। আপনি যেদিন চলে আসেন সেই রাতে বড়াকাঠি আগুনে উত্তপ্ত করে বুকের এই খানটায় পুড়ে এম অক্ষর লিখি। আপনার নামের প্রথম অক্ষর। মুহিতুর রহমান। বিশ্বাস করবেন ? একটুও জ্বলে নি। ব্যথা পাইনি। দীর্ঘ দিন নিজে নিজে পেকে গলে এক সময় শুকিয়ে এমন হয়েছে। “
এই পর্যন্ত বলে রুমাইসা ব্লাউজের উপরের দিকের একটি বোতাম খোলে সম্পূর্ণ দাগটা দেখায়। মাখনের মাঝে যেনো ঈষৎ লাল রঙের এম্বুসে লেখা এম স্পষ্ট।
“এরপর একবার ধান ক্ষেতে ছিটানো কিটনাশক খেয়ে দেখেছি মৃত্যুর যন্ত্রনা বিরহের যন্ত্রনার চেয়ে অনেক কম। বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না , আপনাকে পাবার আমার কোন উপায় ছিল না। আমি বাবার একমাত্র আদরের কন্যা। বাবা সব বুঝে গিয়েছিলেন। তিনি ছোটে গিয়েছিলেন আপনার মায়ের কাছে। আপনাকে ভিক্ষা চেয়েছিলেন। এতো কঠিন বাবা আমার কত ছোট হয়েছেন কল্পনাও করতে পারবেন না। বাবা আপনার লেখা পড়ার সব দায়িত্ব একাই নিতে চেয়েছিলেন। আপনার মা রাজি হননি ।তবে কথা দিয়ে ছিলেন আমাকে পুত্র বধূ করে ঘরে আনবেন। “
এপর্যন্ত বলে রুমাইসা থেমে আবার বলা শুরু করলো। “ আমার আর কিছুই বলার নাই। আপনার যদি বিশ্বাস হয়ে থাকে তবে আমাকে হৃদয়ে ঠাঁই দিন। অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি নিই।
আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। রুমাইসা যদি সত্য বলে থাকে তবে সে স্বাভাবিক মানুষ নয়। অস্বাভাবিক মানুষের সাথে সংসার করা কতটুকু সুখের হবে। আর যদি উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে পার পেতে চায় তাহলে আর কি করার আছে। যাই হোক, এতটুকু বুঝেছিলাম যে আমি কঠিন ষড়যন্ত্রে ফেঁসে গিয়েছি। এখান থেকে আর বাকি জীবনে মুক্তি পাওয়া সম্ভব হবে না।
এরপর জল গড়িয়েছে দূর, বহু দূর। জীবন থেমে থাকেনি। সময় কত কিছু বলে দিয়েছে। যে কথা রুমাইসা বলতে পারেনি আমাকে, আমি বলতে পারিনি রুমাইসাকে, সেই কথা খুব সহজে বলে দিয়েছে আমাদের উভয়কে।
রুমাইসা আসলেই স্বাভাবিক মানুষ নয়। অতি ক্ষমতাশীলা একজন নারী। ভালোবাসার ক্ষমতায় বলিয়ান একজন মহিয়ৈষী। জীবনের পড়ন্ত বেলায় কত কিছু ভাবি। রুমাইসা কি না করেছে। বিয়ের পর থেকে পানি পান করার জন্য দুটি গ্লাস ব্যবহার করতে দেয়নি । সবসময় একটি গ্লাস ব্যবহার করেছে। গ্লাসের যে অংশে আমার ঠোঁটের স্পর্শ লাগে ঠিক সেখানে তার ঠোঁট লাগিয়ে পান করতে চেষ্টা করেছে । বিছানায় বালিশ থাকে এক জোড়া। তবে তার বালিশ সবসময় থাকে ভর মুক্ত। আমার বাহুকে বালিশ না বানালে তার ঘুম আসে না। খানা খেতে হবে এক থালে। এক লুকমা যদি আমার পেটে যায় তবে আরেক লুকমা যাবে তার পেটে। কত দিন তার না খেয়ে পার করতে হয়েছে আমি বাসায় ফিরতে পরিনি কারণে। কত যে গল্প দুজনের , কত যে ইতিহাস ভালোবাসার। !
একবার বাইক এক্সিডেন্ট করে হাসপাতালে ছিলাম বায়ান্ন দিন। আমাকে বুঝতে না দিয়ে প্রতিদিন রোজা রেখেছে সে। তার আবার মহামহীয়ানের প্রতি অগাধ আস্থা। আমার জীবনে সামান্য একটু বিপদ আপদ আসলেই প্রভুর দরবারে শুরু করে রুনাজারি।
গতকাল পার করলাম আমাদের বাইশতম বিবাহ বার্ষিকী। মনে করতে পারি না আটহাজার ত্রিশটি দিনের মাঝে কতদিন আমরা আলাদা থেকেছি।একসাথে থাকবে বলে সে কত বাহানার কথা সবার মাঝে ছড়িয়েছে। আমি নাকি একা ঘুমাতে পারি না, ঘুম ভেঙ্গে গেলে ভয় পাই, ঘুমের মাঝে বোবা ধরে তাই আমাকে একা ঘুমাতে দেয়া ঠিক হবে না তাকে সাথে থাকতে হবে।
সমাপ্ত