হুমায়ুন আহমেদ স্যারকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ভালো লেখক হতে হলে কী প্রয়োজন?
এর উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘আসলে ভালো লেখক হতে হলে আগে নিজেকে জানতে হবে। নিজের জ্ঞানের গভীরতা মাপতে শিখতে হবে। আমি কী লিখতে চাই, কীভাবে লিখতে চাই, কোন ঢং-এ লেখাটা উপস্থাপন করবো, পাঠকের ফিডব্যাক কী হতে পারে, সবকিছুই ভালো লেখকের এক একটি উপকরণ। সমসাময়িক চাহিদা বোঝার মানসিকতা মাথায় রেখে লিখতে বসলে এমনিতেই পাঠক যা চায় তা-ই লিখতে পারবে একজন লেখক। সবচেয়ে বড় কথা হলো, পাঠকের মাঝে নিজের নবজন্ম লেখাটার স্থান করে নেয়ার মধ্যেই কিন্তু লেখকের তপস্যার ষোল আনা নির্ভর করে। এর ওপরেই লেখকের জনপ্রিয়তা কিংবা ভালো লেখক হওয়ার রহস্য নির্ভরশীল। আরেকটা বিষয় মাথায় রাখবে হবে তা হলো অধ্যয়ন। চেষ্টা করতে হবে দেশের বাইরের সাহিত্যিকদের গল্প, উপন্যাস, জীবনী পড়ার। দেশীয় সাহিত্য তো অবশ্যই পড়তে হবে।’
লিখতে হলে পড়তে হবে—তরুণ লেখকদের প্রতি প্রথমত এটিই আমার বলার কথা। মনে রাখতে হবে, লেখকের পথ বড়ই বিপদসংকুল। এটা সম্পূর্ণ একার পথ। কঠিন এক সাধনা। কোনো লেখকের পক্ষে কি বলা সম্ভব, তিনি কেন লেখক হয়েছেন? মাঝেমধ্যে আমার মনে হয়, লেখক না হয়ে উপায় ছিল না বলেই শেষ পর্যন্ত লেখক হয়েছি। খুব ছোটবেলা থেকে কেন যে কবিতা, গল্প—এসব লিখতাম, আজ সেটা স্মৃতি খুঁড়ে বের করা কঠিন। বলা যায়, যে পৃথিবীতে বেঁচে আছি সেই পৃথিবীর একটা অর্থ ও ব্যাখ্যা তৈরি করতে পারি লেখার মাধ্যমে। এটি হয়তো প্রত্যেক লেখকই পারেন। তবে এ ক্ষেত্রে একজন লেখকের সমাজ-রাষ্ট্র-পৃথিবী সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট একটা ধারণা থাকা জরুরি। লেখক হতে চাইলে তুমি যা কিছু করতে চাও, তার সবই তোমাকে লেখার ভেতর দিয়ে প্রতিফলিত করতে হবে। ব্যক্তি ভেদে একেকজন লেখকের লেখার কৌশল একেক রকম। আমি যেমন সাধারণত একটি লেখা একবারেই লিখে ফেলি। কিন্তু লেখাটি লেখার আগে, তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা থাকে বিস্তর। কীভাবে আগের লেখা থেকে নতুন লেখাকে আলাদা করা যায়—এই ভাবনাও থাকে। আমি মনে করি, প্রত্যেক লেখকই তাঁর নিজস্ব জগৎ তৈরি করে নেন একান্ত তাঁর মতো করে।
-হাসান আজিজুল হক
* আইসল্যান্ডে একটা প্রবাদ আছে- ‘এড গানগা মেড বক আই মাগানাম’। এর মানে হলো, প্রত্যেকের পেটেই একটা করে বই আছে। প্রবাদটা আইসল্যান্ডের বেলায় খুবই সত্য। দেশটিতে প্রত্যেক ১০জন লোকের মধ্যে একজনকে পাওয়া যাবেই যিনি বই প্রকাশ করেছেন। আইসল্যান্ডের রাজধানী রেকজাভিকে লেখকদের এড়িয়ে চলাই মুশকিল। দেশটিতে লোকসংখ্যা মোটে ৩ লাখ। কিন্তু লেখক অনেক, বইও অনেক। আর এখানকার লোকেরা পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় চাইতে বই পড়েনও বেশি।
* সম্পাদনা ও পুন:লিখন : গল্প লেখা শেষ হবার পর আপনাকে বসতে হবে সম্পাদনার খুব ধারালো কাঁচি নিয়ে। প্রথমে শুরু করতে হবে বানান, বিভক্তির ব্যবহার, ক্রিয়াপদের ব্যবহার এসব ঠিকঠাক করার জন্য। বানান সমতার একটা বিষয়ও আছে। রবীন্দ্রনাথের পাণ্ডুলিপির ভেতরের সম্পাদনার বহু চিহ্ন মিলে ছবির আকৃতি ধারন করেছে। পাশ্চাত্যের পেশাদার লেখকরা একই লেখা কমপক্ষে তিন বার লেখেন। প্রথম খসড়াকে তাঁরা অখাদ্য বিবেচনা করেন। এটা কাউকে দেখতে পর্যন্ত দেন না। প্রথম খসড়া বড়ো জোর গল্পটা সম্পর্কে ধারনা সৃষ্টির কাজেই ব্যবহার করা হয়। দ্বিতীয় খসড়াও তাঁরা ত্রুটি সংশোধনের জন্য সম্পাদনা করেন না। এটা ব্যবহার করা হয় কাঠামো বদল (যদি দরকার মনে করেন লেখক) প্লট বা গল্পের সব চরিত্রের ঘষামাজা বা মূল বক্তব্যের সঠিক উপস্থাপন কৌশল ঠিক করার জন্য। তৃতীয় খসড়ায় গিয়ে চূড়ান্ত ঘষা মাজা করে সম্পাদকের টেবিলে পাঠান (কেউ কেউ পাঁচ/সাতবারও লেখেন একই লেখা)।
পাশ্চাত্যের বড়ো প্রকাশকরা পেশাদার সম্পাদকদের মাধ্যমে সম্পাদনা ছাড়া কোন লেখা প্রকাশ করেন না। এটা সুপারহিট লেখক বা নোবেল পুরস্কার জয়ী লেখকদের জন্যও প্রযোজ্য। নোবেল জয়ীদের ক্ষেত্রে ঘষামাজার মাত্রা বাড়ে বই কমে না।
*স্টাইল নিয়ে দুশ্চিন্তা নয়
একজন খাঁটি লেখক তার লেখা নিয়েই চরম ব্যস্ত। স্টাইল নিয়ে মাথা ঘামানোর এত সময় কই! “আমি মনে করি কোন গল্প নিজেই স্টাইল ধরে নেয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। লেখককে এত দুশ্চিন্তা করতে নেই। স্টাইল নিয়ে অতি দুশ্চিন্তার ফলে একটা মহামূল্যবান (!) ‘বাজে সাহিত্য’ জন্ম নিবে। ঐগুলো আসলেই অর্থহীন। হয়তোবা দেখতে সুন্দর, শ্রুতিমধুর মনে হবে কিন্তু ভেতরে মাল (সার) নেই।”
-নোবেল বিজয়ী লেখক উইলিয়াম ফকনার
* আপনি যদি আইডিয়া নোট করে রাখতে যান তাহলে আপনি হয়ত রাখতে পারবেন। কিন্তু আবেগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন। আপনি হয়ে যাবেন একজন অবজার্ভার। তাই আমি বলি, ভুলে যান নোট রাখার কথা।যা গুরুত্বপূর্ণ তা এমনিতেই থাকবে। যা গুরুত্বপূর্ণ না তা চলে যাবে।
আপনি যদি খুব খুব গবেষনা করে, প্রচুর তথ্য উপাত্ত্ব দিয়ে বই লিখেন তাহলে নিশ্চিত আপনি হয়ে উঠবেন একজন বিরক্তিকর লেখক আপনার পাঠকের কাছে। বই আপনি কত টা জানেন তা দেখাতে নয়। বই আপনার আত্নার শক্তি দেখাতে।
-দি আলকেমিস্টের লেখক পাওলো কোয়েলহো
*‘এটা আগেও বলেছি যে আমি মনে করি লেখকরা চোর-বাটপার। অন্যদের থেকে প্রয়োজনমত সে চুরি করে নেয়। এটা অনেকটা প্রকাশ্যে সততার সাথে করে থাকে। তবে এ চুরির মাহাত্ম্য হলো এই যে, সে ও তার চেয়ে (যার থেকে চুরি করেছে) ভালো কিছু উপহার দিতে চায়। যাতে ভবিষ্যতে অন্য কোন নতুন চোর তার থেকে চুরি করে তাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে।’’
-নোবেল বিজয়ী লেখক উইলিয়াম ফকনার
* জীবনের গভীর পর্যবেক্ষণ ভাল লেখালেখির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাহিরের ঘটনাবলি শুধু দেখা ও শোনাই যথেষ্ট নয়, এগুলো তোমার মনোজগতে কি প্রভাব ফেলে তাও খেয়াল করতে হবে। কি কারণে কি ধরনের প্রভাব ঘটে তা ব্যাখ্যা করার ক্ষমতাও থাকতে হবে। তোমার আবেগের ও অনুভূতির পেছনের সুনির্দিষ্ট কারণ যদি ধরতে পারো এবং তোমার গল্পে যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারো তাহলে পাঠকরাও তোমার আবেগ-অনুভূতিকে অনুভব করতে পারবে।
-হেমিংওয়ে
* সকলেই লেখেন না, কেউ কেউ শুধু বলেই যান, আর অন্যে তা লেখে হয়ে যায় লেখক। কারও মুখের কথাই লেখা হয়ে যায় যদি তাতে প্রাণ থাকে। “নেপোলিয়নের প্রতিটি কথা এবং তার লেখার প্রতিটি লাইন পড়ার মতো, কারণ তাতে আছে ফ্রান্সের প্রাণ।” বলেছিলেন অ্যামেরিকান প্রবন্ধকার র্যাল্ফ ওয়ালডো ইমারসন। এমন ব্যক্তিদেরকে মনে নিয়েই হয়তো বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন বলেছিলেন, “হয় পড়ার মতো কিছু লেখো, নয়তো লেখার মতো কিছু করো।
*ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সি-খ্যাত ঔপন্যাসিক হেমিংওয়ের ভাষ্যমতো, লেখক হবার জন্য লেখার কোন প্রয়োজন নেই। টাইপরাইটারের সামনে গিয়ে রক্তক্ষরণ করলেই তা হয়ে যাবে লেখা। লেখক হতে হলে ভাষাজ্ঞানের চেয়েও দরকারি বিষয় হলো একটি বিদগ্ধ হৃদয়।
* বেকনের ভাষায়, পড়া মানুষকে পরিপূর্ণ করে, সম্মেলন মানুষকে প্রস্তুত করে আর লেখায় মানুষকে শুদ্ধ করে। কীভাবে একটি কবিতা শেষ হবে এই ভেবে রবার্ট ফ্রস্ট কখনো কবিতা লিখতে শুরু করেন নি। লেখতে লেখতে তিনি আবিষ্কার করেছিলেন নিজেকে।
কিন্তু কী লিখবো? আমার ছাত্রজীবনে এ প্রশ্নের উত্তরে আমার প্রিয় শিক্ষক বলেছিলেন, “কিছু যে লেখতে পারছো না, তা-ই লেখো।”
*ভালো লেখার তিনটি গোপন রহস্য আছে, তুমি তা জানো? এক অধ্যাপক জিজ্ঞেস করলেন তার ছাত্রকে। ছাত্র তো নির্বাক। ভাবছে স্যারের মনের কথা বলার জন্যই ভূমিকা করছেন। তাই ছাত্র অপেক্ষার দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকলো স্যারের দিকে। শেষে জিজ্ঞেসই করতে হলো, স্যার আপনি কি তা জানেন? অন্য দিকে উদাসীন দৃষ্টি দিয়ে স্যার বললেন, নাহ, আমিও জানি না।
ভালো বলেছেন
ReplyDelete