Tuesday 25 April 2017

২০১৪ সালের জুনের প্রথম দিকে মুন্সিগঞ্জে কী একটা মূর্তি পাওয়ার খবর বের হয়েছিল

২০১৪ সালের জুনের প্রথম দিকে মুন্সিগঞ্জে কী একটা মূর্তি পাওয়ার খবর বের হয়েছিল। সেই খবরের সূত্র ধরে মুন্সিগঞ্জে আগে-পরে আরো অনেক মূর্তি পাওয়ার কথা জানতে পারি। তখনই চোখে পড়ে এই মূর্তিটির ছবি। এটা নিয়ে একটা ছোটো পোষ্টও  দিয়েছিলাম--
মুন্সিগঞ্জে প্রাপ্ত একাদশ শতকের পাথরের মূর্তি--ভ্রুকুটিতারা বা পর্ণশবরী দেবীর পায়ের তলায় অবদলিত হয়েছেন গণপতি গণেশ। কিন্তু গণদেবতা এভাবে পায়ের তলায় কেনো?


পরে এই নিয়ে একটু বিশদ আকারে লেখার কথা ভাবছিলাম। ততদিনে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘লোকায়ত দর্শন’ পড়া হয়েছে। দেখলাম ‘লোকায়ত দর্শন’-এর বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে ‘গণপতি—বস্তুবাদের উৎস-সন্ধানে’ নামে পুরো একটি অধ্যায় যেখানে এই গণেশের কাহিনী লেখা হয়েছে। ওটা পড়ে আর এই নিয়ে নতুন করে লেখার প্রয়োজন অনুভব করি নি।
তারপর অনলাইনে ‘বাম’-দের নিয়ে অনেক কাহিনী হয়েছে--নেতাদের ডিগবাজি খাওয়া, আদর্শ থেকে বিচ্যুতি হওয়া--এরকম। এমনকি বাম শব্দটাকে ব্যঙ্গ করে ‘ভাম’ শব্দটা বেশ চালু হয়ে গেছে। এসব দেখে মনে হলো--দেখা যাক--গণপতির কাহিনীর সাথে এই বামদের ভাম হয়ে যাওয়ার কোনো যোগসূত্র আছে কিনা। সেটা অনেকবার ভেবেছি, কিন্তু লিখি লিখি করেও লেখা হয় নি আরেকটা কারণে--তথ্যগুলো ‘ডবলচেক’ করার অবকাশ বা সুযোগ হয় নি। এত সব পুরানো বইপত্র/ধর্মগ্রন্থে গণেশের কাহিনী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে যে সব জোগাড় করে যাচাই করা আসলেই কঠিন। আশা করি এসব বিবেচনা করে এই দিক দিয়ে একটু ছাড় দেবেন।
গণপতি শব্দের অর্থ দিয়ে শুরু করা যাক। আমরা এই কিছুদিন আগে শাহবাগে ‘গণজাগরণ’ দেখেছি। তাতে এই ‘গণ’ শব্দের অর্থ আর নতুন করে ভেঙে বলার দরকার দেখছি না। দেবীপ্রসাদ অনেক তথ্যপ্রমাণ হাজির করে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে ‘গণ’ শব্দের অর্থ--সাধারণ জনগণ। সেই অর্থে গণপতি হলো--জনগণের পতি, বা সমাজের মোড়ল, বা বর্তমানে সহজ অর্থ--নেতা; পৌরাণিক ভাষায়--জনসংঘের দেবতা।
গণপতি অর্থাৎ গণেশ অনেককাল ধরে হিন্দুদের পূজাপার্বণে সবার আগে পূজা পায়। অর্থাৎ আগে গণেশের পূজা করে তারপর আর সব পূজা বা শুভকাজে হাত দিতে হয়। অনেক হিন্দুদের ঘরের বাহির হওয়ার দরজার উপরে গণেশের ছবি বা মূর্তি থাকে--একে প্রণাম বা স্মরণ করে হিন্দুরা ঘর থেকে বের হয় এই বিশ্বাসে যে গণেশ সমস্ত বাধাবিঘ্ন দূর করে দেবে। এজন্য গণেশের অন্য নাম সর্ববিঘ্নহর ও সর্বসিদ্ধিদাতা। এখান থেকেই প্রশ্নের উদয় যে, এমন একজন দেবতা কেন পর্ণশবরী দেবীর পায়ের তলায় গড়াগড়ি খাবে?
[উপরে দেয়া ছবিটি সম্পর্কে বাংলাপিডিয়া পর্ণশবরী দেবীর কথাই উল্লেখ করেছে--‘মূর্তিতত্ত্ব’ নামক রচনাটিতে ৪০ নং চিত্রে উপরের ছবিটি সম্পর্কে বলা আছে--“পর্ণশবরী নামে অনিন্দ্যসুন্দর বৌদ্ধ প্রতিমা শুধু পূর্ববঙ্গ থেকেই পাওয়া গেছে। পর্ণশবরী উপজাতীয় নারী, যিনি পরিধেয় হিসেবে বৃক্ষপত্রাদি পরিধান করেন। স্ফীত উদর বিশিষ্ট এ দেবী প্রত্যয়ালীঢ় ভঙ্গিতে রুগ্নতার প্রতীক দুজন পুরুষকে পদদলিত করছে। এ দেবী তিন মাথা ও আট বাহু বিশিষ্ট। মূতির্র ছয় হাতে ঘড়ির কাটা অনুযায়ী রয়েছে যথাক্রমে অঙ্কুশ, তীর, বজ্র, পর্ণগুচ্ছ, ধনুক ও তর্জনী মুদ্রা। তিনি দুজন পার্শতদেবীসহ উপস্থাপিত। এদের মধ্যে একজন গাধার উপরে উপবিষ্ট। এছাড়া বেদির নিচে গণেশ মূর্তি দেখা যাচ্ছে, যার এক হাতে তরবারি ও অন্য হাতে ঢাল। ভাস্কর্যটি বিঘ্ন বা বাঁধাকে প্রকাশ করছে। উপরে মাঝে অমোঘসিদ্ধিসহ পঞ্চবোধিসত্ত্ব দৃশ্যমান। বজ্রযোগিনী ও নয়নন্দাতে আবিষ্কৃত ও বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত ভাস্কর্য দুটি আনুমানিক এগারো শতকের।”]
দেবীপ্রসাদ বলেছেন--“অনেক মূর্তিতেই দেখতে পাওয়া যায় গণেশ কোনো-না-কোনো আভিজাতিক দেবদেবীর পায়ের তলায় অবদলিত হয়েছেন।”--অর্থাৎ এরকম মূর্তি আরো আছে। আর এটা যে বর্তমান গণপতিই পূর্বাবস্থা, সেটাও তিনি তুলে ধরেছেন--“বাংলা দেশেই পাথরের মূর্তি পাওয়া গিয়েছে যেখানে দেখা যায় গণেশ অবদলিত হয়েছেন ভ্রুকুটিতারা বা পর্ণশবরীর পায়ের তলায়। তবু তাঁর হাতে ঢাল-তলোয়ার দেখে অনায়াসেই অনুমান করা যায় বিনা যুদ্ধে তিনি আত্মসমর্পণ করেননি। বিশেষ করে লক্ষ্য করা দরকার, এই মূর্তিতে গণেশের গজানন নেই—মুখটা কদাকার, কিন্তু মানুষেরই মুখ। তিব্বতে পাওয়া ব্রোঞ্জ-এর মূর্তিতে দেখি দেবতা মহাকাল গণেশকে পায়ের তলায় দলছে। মঞ্জুশ্রীর পায়ের তলায় অবদলিত অবস্থায় গণেশের মূর্তিও একান্ত দুর্লভ নয়। তার চেয়েও চিত্তাকর্ষক হলো আর এক রকম মূর্তি যেখানে গণেশকে দেখানো হয়েছে বিঘ্নহন্তা বলে এক দেবতার পায়ের তলায়। নামেই প্রমাণ, বিঘ্নকে জয় করবার কল্পনা থেকেই বিঘ্নহন্তার জন্ম—এই মূর্তিতে বিজিত গণেশ তাই সাক্ষাৎ বিঘ্নই। নেপালের উপকথায় এই বিঘ্নহন্তার যে বৃত্তান্ত পাওয়া যায় তা থেকেও প্রমাণিত হয় বিঘ্ন বলতে এখানে গণেশই।”
ওটা যে গণপতি-ই, সে নিয়ে আর সন্দেহ নেই। কিন্তু ওসব দেবতাদের ‘বিঘ্নহন্তা’ নাম দেখে প্রশ্ন জাগে তারা কেন এই গণপতিকেই ‘বিঘ্ন’ মনে করে ‘হন্তা’ করতে উদ্যত হলেন? গণেশের নাম অন্য নাম সর্ববিঘ্নহর ও সর্বসিদ্ধিদাতা হলেও অতুলচন্দ্র গুপ্ত সরাসরি বলছেন, “আদিতে গণেশ ছিলেন কর্মসিদ্ধির দেবতা নয়, কর্মবিঘ্নের দেবতা”। গণপতি আগে কিভাবে কাদের কর্মে বিঘ্ন দিতেন, সেসব দেবীপ্রসাদ সুন্দর করে তুলে ধরেছেন। সেই সাথে এটাও মনে করিয়ে দিয়েছেন যে এই গণপতি একক কেউ নয়, গণেশ বহু, তার নামও বহু--গণপতি কোনো নামবাচক শব্দ নয়, ওটা বিশেষণ, যেমন ইন্দ্র কোনো দেবতার নাম নয়, বরং একটা পদের নাম--পদবী--স্বর্গের রাজা।
দেবীপ্রসাদ এই গণপতির সূত্র ধরে বস্তুবাদের উৎস-সন্ধান করতে গিয়ে প্রমাণ দেখিয়েছেন যে গণপতির শুরুতে বসে আছেন দেবতাদের গুরু বৃহস্পতি। এই লেখায় আমরা অতদূর যাব না--গণপতি কী করে বিঘ্নরাজ থেকে বিঘ্নহর হলেন--এটুকু দেখলেই সাম্প্রতিক ‘বাম থেকে ভাম’ হওয়ার অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাব।
বৈদিক যুগ থেকে সংক্ষেপে--আর্যরা যখন ভারতে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছিল, তখন তারা যে অনেক যুদ্ধ করেছিল, লুটপাত করেছিল, অনেক বাধাবিঘ্নের সম্মুখীন হয়েছিল, তার প্রমাণ ঋগ্বেদেই আছে। তো এই বাধাটা দিত কারা? স্থানীয়রা--যাদেরকে আমরা অনার্য বলি--নানা আদিবাসী কৌম সমাজ। এই সাধারণ মানুষগুলোই ‘গণ’--এদের গোত্র নেতাই ‘গণপতি’। আর্যরা অনায়াসে তখন ওসব বিঘ্ন পার হয়ে এসেছে। তবে সবচেয়ে বড় বিঘ্ন এসে হাজির হলো কখন?
যারা রাহুল সাংকৃত্যায়নের ‘ভোলগা থেকে গঙ্গা’ পড়েছেন, তারা জানেন গল্পের মাধ্যমে রাহুল সহজ-সরল ভাবে দেখিয়েছেন যে, একটা পর্যায়ে এসে মানুষের আর ইন্দ্র-বরুণ দেবদেবতাদের প্রতি বিশ্বাস থাকছিল না, তারা ওসব দেবদেবতাদের প্রমাণ চাইত। আর তখন শাসকশ্রেণী ব্রাহ্মণদের শরণাপন্ন হলো জনগণের ওই বিদ্রোহ/অবিশ্বাসী মনোভাব দূর করে দেয়ার জন্য। কারণ মানুষ যখন অবিশ্বাসী হয়ে ওঠে, সব কিছুতে তথ্য-প্রমাণ খোঁজে তখন তাদেরকে শাসন-শোষণ করা শাসকদের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তখন ব্রাহ্মণেরা এমন এক দেবতার আইডিয়া প্রচার শুরু করল যাকে দেখা যায় না, ধরা যায় না--শুধু বিশ্বাসী মন নিয়ে অনুভব করা যায়। এই দেবতাই হলো--নিরাকার ব্রহ্ম।
নিরাকার দেবতা বা ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের এই ধারণা দেন ব্রাহ্মণ্যযুগের যাজ্ঞবল্ক্য। সুকুমারী ভট্টাচার্য তাঁর ‘বেদে সংশয় ও নাস্তিক্য’ প্রবন্ধমূলক গ্রন্থে তথ্যপ্রমাণসহ ওই কাহিনী তুলে ধরেছেন। যাজ্ঞবল্ক্য যখন নিরাকার ব্রহ্মের ধারণা উপস্থাপন করেন, তখন কেউই এটা মেনে নেয় নি। এ নিয়ে তুমুল তর্কবিতর্ক হয়েছিল, অনেকেই যাজ্ঞবল্ক্যকে এই ব্রহ্ম আইডিয়া সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিল। যাজ্ঞবল্ক্য মোটামুটি সবাইকে পিছলামি টাইপের উত্তর দিয়ে পার পেয়ে গেলেও গার্গীর প্রশ্নে ধরা খান।
ছান্দ্যোগ্যোনিষদ থেকে সুকুমারীর তুলে ধরা সেই কথোপকথনের কিছু অংশ এখানে তুলে ধরছি-- “...গার্গী প্রশ্ন করলেন... : --এ সমস্তই যখন জলে ওতপ্ৰোত, তখন জলের আধার কী? --বায়ু। --তার? —অন্তরিক্ষলোকসমূহ। --তাদের? --গন্ধৰ্ব্বলোক, সেটি আদিত্যলোকে, সেটি চন্দ্রলোকে, সেটি নক্ষত্রলোকে, সেটি দেবালোকে, সেটি ইন্দ্রলোকে, সেটি প্রজাপতিলোকে, সেটি ব্রহ্মলোকে। -সেটি? যাজ্ঞবল্ক্যের অসহিষ্ণু উত্তর ‘যে দেবতা প্রশ্নের অতীত আপনি তাঁর সম্বন্ধে প্রশ্ন করছেন।’ আরও অনেকে যাজ্ঞবল্ক্যকে প্রশ্ন করেছিলেন। কিন্তু একমাত্র গার্গীকেই যাজ্ঞবল্ক্য ধমকে বলেছিলেন, ‘তোমার মাথা খসে পড়বে। যদি আর বেশি প্রশ্ন করা’।”
অর্থাৎ ওই ব্রহ্মলোক হলো প্রশ্নের অতীত, ওটা শুধু বিশ্বাসের ব্যাপার। রাহুল সাংকৃত্যায়ন এই জায়গাটায় দেখিয়েছেন যে ব্রাহ্মণদের এহেন ভাওতাবাজির বিরুদ্ধে চার্বাকরা রুখে দাঁড়িয়েছিল। তারা কোনো ভাবেই এই নিরাকার ঈশ্বরের বিষয়টা মেনে নিচ্ছিলেন না। যাজ্ঞবল্ক্য-স্মৃতিতেও এই সময়কার কাহিনী বিবৃত আছে যেখানে ‘যাজ্ঞবল্ক সরাসরি বলছেন যে, বিঘ্নসাধন করবার জন্যেই বিনায়কেরা নিযুক্ত আছেন।’ বিনায়ক গণপতি গণেশেরই আরেক নাম। কিন্তু এখানে লক্ষ্যনীয়-- ‘বিনায়কেরা’ বলা হয়েছে, অর্থাত গণপতি একাধিক। দেবীপ্রসাদ তৎকালীন আরো অনেক ব্রাহ্মণ্যসাহিতে আরো অনেক নাম খুঁজে পেয়েছেন--‘বিঘ্নেশ, বিঘ্নকৃৎ, বিঘ্নেশ্বর, বিঘ্নরাজ, ইত্যাদি। চলতি কথায়, ‘যতো নষ্টের গোড়া’—ট্রাবল-মেকার। দুর্বৃত্তদের পাণ্ডাও বলতে পারেন।’ অর্থাৎ এসময় থেকেই বিশ্বাসীদের কাছে এই ‘অবিশ্বাসীরা’ ‘দুর্বৃত্ত’ হিসাবে পরিচিতি লাভ করে।
এবার এইসব সমাজপতিদেরকে শায়স্তা করতে হবে, না হলে তো ঐ নিরাকার ব্রহ্মকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা যাচ্ছে না! খুব সম্ভবত ব্রাহ্মণদেরকে উদ্ধার করতে এইসময়েই পরশুরামের আবির্ভাব হয়। দেবীপ্রসাদ বলেন--‘হিংসার ভিত্তিতে ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যের এমন জঙ্গী প্রবর্তকের কথা শাস্ত্রগ্রন্থে নিশ্চয়ই অদ্বিতীয়।’ বলা হয়ে থাকে পরশুরাম নাকি শান্তি আনতে ধরিত্রিকে ২১ বার ক্ষত্রিয়শূন্য করেছিলেন। ‘২১ বার ক্ষত্রিয়শূন্য’ কথাটা বাড়াবাড়ি--খুব সম্ভবত ২১ জন গণপতিকে পরাস্ত করেছিলেন। পৌরাণিক কাহিনীতে গণেশের সাথে পরশুরামের যুদ্ধের কাহিনীও আছে, তুলে দিচ্ছি-- “...লড়াই করতে করতে পরশুরাম তাঁর হাতের কুঠারটা ছুঁড়ে মারলেন গণেশের দিকে। তারই আঘাতে গণেশের একটা দাঁত উড়ে গেলো। অবশ্যই, তাই বলে গণেশকে পরশুরামের তুলনায় দুর্বল মনে করা চলবে না। কেননা, ব্রহ্মাণ্ডপুরাণে বলা হয়েছে, ইচ্ছে করলে গণেশ ওই কুঠারাঘাতকে প্রত্যাখ্যান করতে পারতেন। কিন্তু গণেশ দেখলেন, কুঠারটি তাঁর পিতার হাতের তৈরি, তাই কুঠারকে নিষ্ফল করলে পিতাকে অমর্যাদা দেখানো হয়। তাই পিতার মর্যাদা রক্ষা করবার জন্যেই গণেশ একটি দাঁত এগিয়ে দিয়ে কুঠারের আঘাতটা গ্রহণ করে নিলেন।”--এ কারণেই বর্তমানে গণেশের মূর্তিতে একটি দাঁত দেখা যায়, বা একটি দাঁর ভাঙা অবস্থায় দেখা যায়। তবে সাধারণ জ্ঞানের দিক দিয়ে হাতির মাথাটা একান্তই অবাস্তব। তবুও অনেক প্রাচীন দেবদেবতার মাথায় বিভিন্ন জন্তুজানোয়ারের মুখ দেখা যায়--যা মূলত টোটম বিশ্বাস থেকে আসছে। গণেশের হাতির মাথাটাও অনেকটাই তাই। এছাড়া হয়তো তাকে শক্তিশালী দেখাতে হাতির চেয়ে শক্তিশালী আর কিছু পাওয়া যায় নি বলে হাতির মাথাটাই জুড়ে দিয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে আর্যরা ঘোড়া চিনত, কিন্তু হাতি চিনত না। তারা হাতি দেখে ভারতে এসে। আর অনেক যুদ্ধে অনার্যরা যে তাদেরকে হাতি দিয়ে পরাস্ত করেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায়। এছাড়া হয়তো ব্রাহ্মণেরা গণেশকে প্রথমে কদাকার, ঘৃণিত কিছু হিসাবে উপস্থাপন করতে চেয়েছিল বলে এই হাতির মাথা।
সে যাই হোক, মানুষের শরীরের সাথে হাতির মাথা যে অবাস্তব কল্পনা সেটা এই গণেশকে নিয়ে পৌরানিক কাহিনীর স্ববিরোধী একাধিক গল্প থেকেই প্রমাণিত। এই অংশটাও ‘ডবলচেক’ করে দেখার সুযোগ হয় নাই--এই নিয়ে ‘ঈসা নবী’ ফেসবুক আইডি থেকে একটা পোস্ট দেয়া হয়েছিল--সেটা তুলে দিচ্ছি--
================== শিব পুরানঃ পার্বতী একদিন নন্দীকে দ্বারী নিযুক্ত করে স্নান করতে যান। এমন সময় শিব সেখানে উপস্থিত হলে, তিনি নন্দীকে তিরষ্কার করে পার্বতীর স্নানাগারে প্রবেশ করেন। এতে পার্বতী অপমানিত ও ক্ষুব্ধ হন। অবশেষে সখী জয়া ও বিজয়ার সঙ্গে পরামর্শ করে তিনি জল থেকে পাঁক তুলে একটি সুন্দর পুত্রের মূর্তি নির্মান করেন ও সেই মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে তাকে নিজের বিশ্বস্ত অনুচর নিয়োগ করেন। এরপর একদিন এই কুমারকে দ্বারী নিয়োগ করে পার্বতী স্নানে গমন করলে শিব তথায় উপস্থিত হন। কুমার শিবকে যেতে বাধা দেন। এতে প্রথমে প্রমথগণের সঙ্গে তার বিবাদ ও পরে পার্বতীর ইঙ্গিতে যুদ্ধ হয়। প্রমথগণ, শিব ও সকল দেবতা এই যুদ্ধে পরাজিত হন। তখন নারদের পরামর্শে বিষ্ণু কুমারকে মোহাচ্ছন্ন করেন ও শিব শূলের দ্বারা তাঁর মস্তক ছিন্ন করেন। এই সংবাদ শুনে পার্বতী ক্রুদ্ধ হয়ে বিশ্বসৃষ্টি বিনষ্ট করতে উদ্যোগী হন। নারদ ও দেবগণ তাঁকে শান্ত করেন। পার্বতী তাঁর পুত্রের পুনর্জীবন দাবি করেন ও ইচ্ছা প্রকাশ করেন যেন এই পুত্র সকলের পূজ্য হয়। কিন্তু কুমারের মুণ্ডটি তখন আর পাওয়া যায় না। শিব তখন প্রমথগণকে উত্তরমুখে প্রেরণ করেন এবং যাকে প্রথমে দেখা যাবে তারই মস্তক নিয়ে আসতে বলেন। তারা একটি একদন্ত হস্তিমুণ্ড নিয়ে উপস্থিত হন ও দেবগণ এই হস্তিমুণ্ডের সাহায্যেই তাঁকে জীবিত করেন। অনন্তর শিব তাঁকে নিজপুত্র রূপে স্বীকার করেন। দেবগণের আশীর্বাদে এই কুমার সকলের পূজ্য হন ও গণেশ নামে আখ্যাত হন।
স্কন্দ পুরানঃ সিন্দূর নামে এক দৈত্য পার্বতীর গর্ভে প্রবেশ করে গণেশের মস্তক ছিন্ন করে। কিন্তু এতে শিশুটির মৃত্যু ঘটে না, বরং সে মুণ্ডহীন অবস্থাতেই ভূমিষ্ট হয়। জন্মের পরে, নারদ এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে গণেশ তাঁকে ঘটনাটি জানান। নারদ এরপর তাকে এর একটি বিহিত করতে বললে, সে নিজের তেজে গজাসুরের মস্তক ছিন্ন করে নিজের দেহে যুক্ত করে।
বৃহদ্ধর্মপুরাণঃ পার্বতী পুত্রলাভে ইচ্ছুক হলে শিব অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। অগত্যা পার্বতীর পীড়াপীড়িতে শিব পার্বতীর বস্ত্র টেনে সেটিকেই পুত্রজ্ঞানে চুম্বন করতে বলেন। পার্বতী সেই বস্ত্রকে পুত্রের আকার দিয়ে কোলে নিতেই সেটি জীবিত হয়ে ওঠে। তখন শিব পুত্রকে কোলে নিয়ে বলেন, এই পুত্র স্বল্পায়ু। উত্তরদিকে মাথা করে শায়িত এই শিশুর মস্তকও তৎক্ষণাৎ ছিন্ন হয়ে যায়। পার্বতী শোকাকুল হন। এমন সময় দৈববাণী হয় যে উত্তরদিকে মাথা করে শুয়ে আছে এমন কারোর মাথা এনে জুড়ে দিলে তবেই এই পুত্র বাঁচবে। পার্বতী তখন নন্দীকে মস্তকের সন্ধানে পাঠান। নন্দী ইন্দ্রের বাহন ঐরাবতের মাথা কেটে আনেন। দেবতারা বাধা দিয়েও ব্যর্থ হন। এই মাথাটি জুড়ে শিব পুত্রকে জীবিত করেন। শিবের বরে, ইন্দ্র ঐরাবতকে সমুদ্রে ফেলে দিলে সে আবার মস্তক প্রাপ্ত হয়।
পদ্মপুরাণঃ হরপার্বতী ঐরাবতের বেশে বনে বিহার করছিলেন, তাঁদের সেই মিলনের ফলে গণেশের জন্ম হয়।
লিঙ্গপুরাণঃ দেবগণ শিবের নিকট উপস্থিত হন ও ব্রহ্মা অসুরদের হাত থেকে নিরাপত্তা চান। শিব তখন নিজ দেহ থেকে গণেশের জন্ম দেন।
দেবীপুরাণঃ শিবের রাজসিক ভাব দেখা দিলে তাঁর দুই হাত ঘামতে থাকে এবং সেই ঘাম থেকে গনেশের জন্ম হয়।
মৎসপুরাণঃ পার্বতী চূর্ণক বা বেসম দিয়ে নিজের গাত্রমার্জনা করছিলেন। সেই সময় এই চূর্ণক দিয়ে একটি হাতির মাথা ওয়ালা মূর্তি নির্মান করে তা গঙ্গাজলে ফেলে দেন। পুতুলটি বিরাট হয়ে পৃথিবী পূর্ণ করতে উদ্যত হলে পার্বতী ও গঙ্গা একে পুত্র সম্বোধন করেন ও ব্রহ্মা একে গণাধিপতি করে দেন।
বামনপুরাণঃ পার্বতী স্নানের সময় নিজের গাত্রমল দিয়ে চতুর্ভূজ গজানন মূর্তি নির্মান করলে মহাদেব তাকে পুত্ররূপে গ্রহণ করেন। বলেন, যেহেতু আমাকে ছাড়াই পুত্রের জন্ম হয়েছে সেহেতু এ বিনায়ক নামে প্রসিদ্ধ হবে এবং বিঘ্ননাশকারী হবে। ===============
এগুলো যে বাড়াবাড়ি রকমের কাহিনী--সে আর বলার অপেক্ষায় রাখে না। মূল প্রসঙ্গে আসি--ওদিকে মনুস্মৃতিতেও স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে গণেশ শূদ্র অর্থাৎ অনার্যদের দেবতা: বিপ্রাণাং দৈবতং শম্ভুঃ ক্ষত্রিয়াণাং তু মাধবঃ। বৈশ্যানাং তু ভবেৎ ব্রহ্মা শূদ্রানাং গণনায়কঃ।। –অর্থাৎ, ব্রাহ্মণদের দেবতা হলেন শম্ভু, ক্ষত্রিয়দের মাধব, বৈশ্যদের ব্রহ্মা আর শূদ্রদের গণনায়ক।
এতক্ষণে বুঝতে আর বাকি থাকে না যে গণেশ বা গণপতি আসলে কে বা কারা, এবং ব্রাহ্মণদের সাথে এর কেন দ্বন্দ্ব। ব্রাহ্মণেরা অনার্য বা শূদ্রদের শাসন-শোষণের ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করতে চায়, আর গণপতি মূলত ওই সাধারণ জনগণের হয়ে ব্রাহ্মণ আর শাসকশ্রেণীর সেই ইচ্ছাতে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। এজন্যই তারা নানা ভাবে গণপতিকে দমন করার চেষ্টা চালাচ্ছে। শেষে যখন দেখি সবাই মিলে একটা ‘হিন্দুসমাজ’ গঠন করেছে, তখন ধরে নিতে পারি একটা সময়ে গণপতির সাথে ব্রাহ্মণদের নিশ্চয়ই আপোষ হয়েছিল--সাম্যবাদী কৌমসমাজগুলো ভেঙে ভেঙে ব্রাহ্মণ্য পুঁজিবাদী সমাজ বা রাষ্ট্র ব্যবস্থার অংশ হয়ে যেতে শুরু করল।
সেই আপোষটা কিভাবে? গাছের পাতা পরিধান করা আদিবাসী দেবী পর্ণশবরীদের পায়ের তলায় যাওয়াটা হয়তো “নারীঘটিত কেলেঙ্কারী”। মুনিঋষিদের বশ করতে উর্বশীদের কাজে লাগানোর কাহিনী তো সবার জানা। আর পরশুরাম বা অন্যান্য দেবদেবীদের সহায়তায় মেরে-কেটে হয়তো সাময়িক দমন করা যাচ্ছিল, পরে আবার কোথাও না কোথাও দিয়ে গণপতির আবির্ভাব হত। এই কাহিনী অনেকদিন চলেছে। আর্য-ব্রাহ্মণ্য সমাজ ব্যবস্থা সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়তে সময় লেগেছে। পুরাণে গণেশের নতুন রূপ দেখা যায় ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণে ও স্কন্দপুরাণে। এখানে উল্লেখ্য যে এই ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণ বাংলাদেশেই সেন আমলের শেষের দিকে রচিত। এসময়ই গণেশকে দেবতার আসন দেয়া হয়, এমনকি পরে রচিত অনেক গ্রন্থে গণেশকে উপনিষদের ব্রহ্ম হিসাবেও দেখানো হয়েছে। এর পর থেকেই গণেশের মূর্তির চেহারা বদলে যেতে শুরু করে। নতুন সর্ববিঘ্নহর ও সর্বসিদ্ধিদাতা রূপ দেখা যাক--



একাদশ শতকেও যে ‘ট্রাবল-মেকার’ গণেশের হাত ছিল দুটো, হাতে ছিল শুধু ঢাল-তরবারি, সেই গণেশ পরে হয়ে উঠল দুইয়ের অধিক হাতওয়ালা, হাতে উঠে এলো পর্ণশবরী দেবীর হাতে থাকা অঙ্কুশ যা দিয়ে হাতি বশে রাখা হয়, আরেক হাতে উঠে এলো পরশুরামের কুঠারের মত কুঠার, সর্বাঙ্গে ‘আধুনিক’ অলংকার-পোশাক, ভোগবিলাশে মত্ত, আরো অনেক কিছু নিয়ে হয়ে উঠল সর্ববিঘ্নহর ও সর্বসিদ্ধিদাতা দেবতা, যে কিনা আর সব দেবতার আগে পূজা পায়। অতুলচন্দ্র গুপ্ত তাঁর ‘শিক্ষা ও সভ্যতা’ গ্রন্থের ‘গণেশ’ প্রবন্ধে বলেছেন, “গণেশের যে-পূজা তা ছিলো এই ভয়ঙ্কর দেবতাটিকে শান্ত রাখার জন্য; তিনি কাজকর্মের উপর দৃষ্টি না দেন, সে-জন্য ঘুষের ব্যবস্থা”।
====================
চাপে পড়ে, স্বার্থ বা লোভের কারণে, ঘুষ খেয়ে বা কামের ফাঁদে পড়ে নারীঘটিত ব্যাপারে জড়িয়ে আদর্শ থেকে বিচ্যুত হওয়া, পতন বা পল্টিবাজির অনেক উদাহরণ আছে। শোষিত, নিপীড়িত, অবহেলিত সাধারণ জনগণের নেতা থেকে, বিঘ্নকারী থেকে, শাসকশ্রেণীর ‘সিদ্ধিদাতা’ হয়ে ওঠা গণপতি গণেশের এই বিচ্যুতি ‘বাম থেকে ভাম’ হয়ে একেবারে প্রথম দিকের অন্যতম প্রধান দৃষ্টান্ত। এই মিছিলে যুগে যুগে আরো অনেকেই নাম লিখিয়েছে। কিন্তু হায়, গোল্ডফিস মেমরির সাধারণ মূর্খ জনগণই এদেরকে আবার ‘পূজার আসনে’ বসিয়েছে।
==================















No comments:

Post a Comment

অভিশপ্ত রজনী

  মৃত মেয়েটিকে ধর্ষণ করার সময় মেয়েটি যে জীবিত হয়ে ওঠে সেটা খেয়াল করেনি নেশাগ্রস্ত অবস্থায় কাব্য।ধবধবে সাদা চামড়ার মেয়েটিকে ভোগ করার...