দীর্ঘ ১০ বছর ধরে চলা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার প্রধান আসামি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
সাবেক কোনো প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতির বিচারের রায় বাংলাদেশে এটিই প্রথম। এ মামলায় হাজিরা দেয়ার বিষয়ে খালেদা জিয়া প্রায় ১৫০ বারের মতো সময় চেয়েছেন। আর মামলাটি খারিজ করার বিষয়ে বার বার আবেদন করা হয়েছে উচ্চ আদালতে হয়েছে বিচারক পরিবর্তনও। তারপরও চলে বিচারকাজ।
এতিমদের সহায়তা করার উদ্দেশ্যে একটি বিদেশি ব্যাংক থেকে আসা ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন -দুদক।
ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দায়ের করা এ মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ছাড়াও অন্য আসামিরা হলেন: দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারমান তারেক রহমান, মাগুরার সাবেক এমপি কাজী সালিমুল হক কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সাবেক সচিব ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান।
আসামিদের মধ্যে তারেক জিয়া চিকিৎসার জন্য লন্ডনে এবং ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও মমিনুর রহমান পলাতক রয়েছেন।
এ মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৯১ থেকে ৯৬ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় খালেদা জিয়ার পক্ষে সোনালী ব্যাংকের রমনা শাখায় 'প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিল' নামে একটি সঞ্চয়ী হিসাব খোলা হয়। যার চলতি হিসাব ৫৪১৬। ওই অ্যাকাউন্টে ১৯৯১ সালের ৯ জুনে এক সৌদি দাতার পাঠানো ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের মাধ্যেমে ১২ লাখ ৫৫ হাজার ডলার যার মূল্য তৎকালীন বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ে বাংলাদেশি টাকায় ৪ কোটি ৪৪ লাখ ৮১ হাজার ২১৬ টাকা অনুদান হিসেবে জমা হয়।
১৯৯১ সালের ৯ জুন থেকে ১৯৯৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ওই অর্থ কোনো এতিম খানায় দান করা হয়নি। এই সময়ের মধ্যে তারেক রহমান তার ছোটভাই আরাফাত রহমান কোকো ও জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট গঠন করা হয়।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের ৫০ লাখ টাকা কাজী সলিমুল হকের নামে ২০০৬ সালের ১২ এপ্রিল জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের অ্যাকাউন্ট থেকে ট্রান্সফার করা হয়।
অভিযোগে আরো বলা হয়, এই শাখায় কাজী সলিমুল হকের নামের পরিবর্তে ২ কোটি টাকার আরো দুটি এফডিআর খোলা হয়। যা তিনি নিজ নামেই ট্রান্সফার করেন।
এছাড়া ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদের ছেলে সৈয়দ আহমেদের নামে একটি এক কোটি টাকা এবং দুজনের যৌথ নামে আরেকটি ১ কোটি টাকার এফডিয়ার খোলেন কাজী সলিমুল হক।
এই দুই এফডিয়ার থেকে গিয়াসউদ্দিন উদ্দিন আহমেদের এফডিআরে ট্রান্সফার হয়। এর কিছুদিন পরই গিয়াস উদ্দিন আহমেদ তার এফডিয়ারের এক কোটি টাকা ভেঙে ৫০ লাখ টাকার ২টি এফডিয়ার করেন। এরপর আবার সেই এফডিয়ার ভেঙে শরফুদ্দিনের অ্যাকাইন্টে ৬টি পে অর্ডারের মাধ্যমে টাকা ট্রান্সফার করেন।
ট্রাস্টের কাজে শরফুদ্দিন আহমেদ ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা তুলে নেন। এই টাকাটি আত্মসাতের অভিযোগেই জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা দায়ের করে দুদক।
দীর্ঘ ১০ বছর ধরে পুরান ঢাকার বকশিবাজারের বিশেষ জজ আদালতে চলা এ মামলাটিতে আদালতে হাজিরা নিয়ে খালেদা জিয়া প্রায় দেড়শ বারের মতো সময় নিয়েছেন। এজন্য কয়েকবার তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করা হয়েছে। মামলাটি বাতিল করে দেয়ার জন্য তার আইনজীবীরা আবেদনের পর আবেদন করেছে উচ্চ আদালতে।
মামলাটিকে করা হয়েছে বিচারক পরিবর্তনও। এরপর ২৩৬ কার্য দিবসে ৩২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ, ২৮ কার্য দিবস আত্মপক্ষ সমর্থন ও ১৬ কার্যদিবস যুক্তি তর্কের শুনানি শেষে আদালত আগামীকাল রায়ের দিন ধার্য করেছে আদালত।
মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে খালেদা জিয়াসহ আসামিদের সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে।
যে কথা অজানা:
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের ঠিকানাই খুঁজে পাওয়া যায়নি।
যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলা করা হয়েছে বাস্তবে সেটির সঠিক কোনো ঠিকানাই খুঁজে পাওয়া যায়নি।
প্রায় ২৫ বছর আগে বিদেশ থেকে এতিমদের জন্য আসা টাকা খালদা জিয়ার দুই ছেলে এবং স্বজনদের নামে ব্যাংকে এফডিআর করে রাখার প্রমাণ মিললেও ওই অর্থ এতিমদের জন্য ব্যয়ের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বে আসার পর অনাথদের সহায়তা দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর 'অরফানেজ ট্রাস্ট' নামে সোনালী ব্যাংকের রমনা শাখায় একটি হিসাব খোলা হয়।
হিসাবের স্বত্ত্বাধিকারী হিসেবে স্বাক্ষরকারী ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। ওই অ্যাকাউন্টে ১৯৯১ সালের জুনে ইউনাইটেড সৌদি কমার্শিয়াল ব্যাংকের একটি ডিডি মারফত বাংলাদেশি টাকায় ৪ কোটি ৪৪ লাখ ৮১ হাজার টাকা জমা হয়। যা পরবর্তী দুই বছর ব্যাংকে অলস পড়ে থাকে।
১৯৯৩ সালে ঢাকা সেনানিবাসের ৬ মঈনুল রোড তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বাসভবনের ঠিকানা ব্যবহার করে জিয়া এতিমখানা খোলা হয়। মঈনুল রোডের বাসার ঠিকানায় গড়ে ওঠা এতিম খানার কাগজপত্রে বরাদ্দ দিয়ে এর সদস্য খালেদা জিয়ার দুই ছেলে তারেক ও কোকোসহ পরিবারের ঘনিষ্ঠজনদের নিয়ে ট্রাস্ট গঠন করা হয়।
এরপর খালেদা জিয়া ৯ বছর ক্ষমতায় থাকলেও এতিমখানা দৃশ্যমান হয়নি। কিন্তু সেই টাকা ট্রাস্ট সদস্যদের ব্যক্তিগত তহবিলে সুদে আসলে বেড়েছে।
ওই একই সময় কাতারের রাজা তৎকালীর পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমানকেও অর্থ সহায়তা প্রদান করেন। সেই টাকায় বাগেরহাটে তার জমিতে জিয়া এতিমখানা নির্মাণ করা হয়। সেখানে বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি নানা সংকটে প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় দেশ বিদেশ থেকে ত্রাণ গ্রহণ করে থাকে।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার এতিমখানা তহবিল থেকে টাকা কি প্রক্রিয়ায় এতিমরা পাবে সেটির কোনো নীতিমালা খুঁজে পাওয়া যায়নি।
পাওয়া গেছে কেবল ব্যাংক হিসাব, টাকা জমা এবং তোলা আর টাকা বরাদ্দের প্রমাণ।
No comments:
Post a Comment