আমার একটা ধারণা হচ্ছে- এই কঠিন-কঠোর পৃথিবীতে কেউ আসলে কাউকে খুব একটা বোঝে না। যার মূল কারণ এর কাঠিন্য। তাই আগের লাইনে 'কঠিন-কঠোর' দুইটি শব্দ ব্যবহার করেছি। আমাদের চারপাশের পৃথিবীটা এত কঠিন যে, জন্মদাত্রী মা’কেও আমরা বঞ্চিত করি। বাবা’কে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিই জীবন থেকে। শুনেছি স্নেহ নাকি সর্বদা নিম্নগামী। যে নিচের দিকে মানুষ হৃদয় নিংড়ানো স্নেহের বস্তা উপুড় করে দেয়, সেই নিচ থেকেই আবার চলে আসে উপরের জনের সঙ্গে করা অন্যায়ের প্রতিশোধ। মানুষ কি ভীষণ অসহায়!
আবার মা-বাবাও কি সন্তানকে বোঝেন? একটি বোধবুদ্ধিহীন শিশুর কখন খাদ্য প্রয়োজন সেটি বুঝতে পারা আর পূর্ণাঙ্গ মানুষের চিন্তাচেতনা বুঝতে পারা এক নয়। আমার কাছে বিষয়টিকে অসম্ভব মনে হয়। যে কারণে অনেক সময় সন্তানের উপকারার্থে মা-বাবা কিছু একটা করতে বা বলতে চাইলেও, সেটা সন্তানের কাছে অযাচিত হয়ে যায়। আবার একই ঘটনায় সন্তানের অবাধ্যতা দেখলে মা-বাবা’ও পীড়িত বোধ করেন। অথচ আসলে যে এর ভেতর মূল ভূমিকা পালন করছে, একটা বড় ধরনের বোঝাপড়ার ঘাটতি, সেটা বোঝে কয়জন?
আর নারী-পুরুষের সম্পর্ক তো এই সবুজ রংএর পৃথিবীতে সবচে’ জটিল একটি বিষয়। কেন যে দু’জন নরনারী একে অপরের কাছে আসে আবার কেন যে সরে যায়, সেটা নির্ণয় করা অসম্ভব। কাছাকাছি আসার আগে ভালোবাসা নামক একটি উপাদান জন্ম নেয় দু'জনের মনে। এ পর্যন্ত আবিস্কার করা গেছে। কিন্তু এই ভালবাসা জিনিসটি কি? এ ব্যপারে কোনো সর্বজনগ্রাহ্য সিদ্ধান্ত নেই। অধিকাংশ নারী-পুরুষের ক্ষেত্রে আবার ভালবাসা ফুরিয়ে যাওয়ার একটি ঘটনা ঘটে। সেটা পৃথিবীর এই জটিলতম বিষয়টির কুৎসিততম একটি রূপ। দু’জন মানুষ- যাদের মধ্যে ভালবাসা ফুরিয়ে গেছে, কিন্তু পাশে থাকার প্রয়োজন ফুরোয় নি; তাদের চেয়ে হতভাগা আর কে হতে পারে?
কিন্তু ভালবাসাজনিত সংকটগুলোর চেহারা কেন এত মারাত্মক হয়? জন্মদাত্রী বা দাতা’র সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদে তো কখনো ওভাবে হৃদয় খান খান হয়ে যায় না; যেটা ক'বছরের পরিচিতের সঙ্গে বিচ্ছেদে হয়ে যায়। এর কারণ হচ্ছে, মানুষ আসলে জন্মগতভাবে স্বার্থপর একটি জীব। সে পৃথিবীতে এসে চিৎকার করে জানান দেয়- কেবলই নিজের স্বার্থ আদায় করতে তার এখানে আসা। আজীবন করেও যায় তাই। মা-বাবাই পৃথিবীতে কেবলমাত্র একটি স্তম্ভ যারা সন্তানের সঙ্গে অনেক কম স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সম্পৃক্ত থাকে। কিন্তু এছাড়া বাকী সবগুলো সম্পর্ক মূলত গড়ে ওঠে স্বার্থের ভিত্তিতে।
কেন নরনারীর সম্পর্কের কথা বলতে গিয়ে মানুষকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে স্বার্থপর বলে উল্লেখ করলাম? ভালবাসা সম্পর্কে আমি কোথায় যেন পড়েছিলাম, এটি অন্য একজনের ভেতরে নিজের প্রতি টনটনে টান দেখতে চাওয়ার আকুতি। আমি এ ধারণাটিকে সমর্থন করি। কিন্তু টনটনে টান দেখতে চাওয়ার আকুতিটি কি রকম? অসুস্থ হলে হাপিত্যেশ করতে হবে বা নানান বেলার খাদ্যায়োজন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকতে হবে বা রাত জেগে সঙ্গ দিয়ে যেতে হবে- এরকম? আমার মনে হয় এগুলোর কোনোটিই আসলে অগুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, অপরপক্ষকে অনুভব করা। সে কি চায়, কেন চায়, কিভাবে চায়- সেটা বুঝতে পারা। এই চাওয়ার বিষয়টাকে যদি উল্টে দেখি; আমি আরেকজনের কাছ থেকে চাচ্ছি যেন সে আমার সব চাওয়াগুলো বোঝে। যেন সে নিজেকে আমার মতো করে সাজায়। সেভাবে নিজেকে আমার কাছে সরবরাহ করে। এটা কি স্বার্থপর চিন্তা নয়? অথচ আমরা এই বিষয়টার চর্চাই করে যাচ্ছি বুঁদ হয়ে, জনম জনম ধরে। যাতে দু’জন সুখী হতে পারি। সুখ? দুইজন স্বার্থপর মানুষের স্বার্থোদ্ধারই কি সুখ? তাহলে তো যে যত বুদ্ধিমান স্বার্থপর, সে তত বেশি সুখী। কেননা সে তত বেশি অপরের স্বার্থ রক্ষা করবে, যাতে অপরপক্ষ তার স্বার্থ নিরন্তর সমুন্নত রাখে। ক্রমাগত এরকম করে গেলেই কি দু’জন মানুষ জীবনে সুখী হয়ে যায়?
এরচে’ পুরুষে পুরুষে সম্পর্ক অপেক্ষাকৃত কম জটিল। কেননা অস্বাভাবিকতা ছাড়া একজন পুরুষ আরেকজনের পুরুষের কাছে মনোদৈহিক চাওয়া-পাওয়ার হিসেব মেলাতে বসে না। তবে তাদের সম্পর্কের জায়গাগুলোও নিঃস্বার্থ নয় মোটেই। পৃথিবীর খুব অল্প সংখ্যক ব্যতিক্রমী জাতি ছাড়া বাকিদের সমাজগুলো সবই পুরুষতান্ত্রিক। সেইসব সমাজে পুরুষ মাত্রই ক্ষমতাধর, বলশালী। আর মানুষমাত্রই ক্ষমতার নিকটবর্তী হতে চায়। তাই একজন পুরুষ আরেকজন পুরুষের সঙ্গে যে সম্পর্কে যুক্ত থাকে, সেটা হচ্ছে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার প্রবৃত্তি থেকে উৎসারিত সম্পর্ক। বুঝতে হবে এটা একটা প্রবৃত্তিগত বিষয়। আদিম যুগের মানুষ আগুন আবিস্কার করে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলো, কারণ আগুন তাদের শক্তি দিয়েছে। তো পুরুষ-পুরুষে সম্পর্ককে বলা যায়- স্বার্থান্বেষী তবে অপেক্ষাকৃত স্বল্পকন্টক একটা সম্পর্ক।
আর নারীতে নারীতে সম্পর্ক তো যেন একটি খেলা। আগেকার আমলে যে কারণে মেয়েরা একে অপরের চোখের বালি হতো। চোখে বালি পড়লে যেমন কচকচ করে, তেমনি একে অপরের চোখের সামনে পড়লে কচকচ করে ঝগড়া করতো। কিন্তু তাতে কারো বিচ্ছেদ হতো না। সর্বোচ্চ মন খারাপ পর্যন্ত হতে পারবে- এই ছিলো সম্পর্কের শর্ত। তাদের এই ঝগড়া ঝগড়া খেলার মধ্য দিয়েই কেটে যেতো বেলা। একসময়। কিন্তু নারীর ক্ষমতায়ন নামক একটি শব্দযুগল, এখন নারীতে নারীতে মেলামেশাকেও পুরুষদেরটার মতো ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার উদ্যোগে রূপান্তরিত করে ফেলছে। যে কারণে এখন আর কেউ কারো চোখের বালি হয় না। একসময় হয়তো এ সম্পর্কটিও পুরোপুরি পুরুষ-পুরুষ সম্পর্কের মতো হয়ে যাবে এবং তাতেই হয়তো নিহিত আছে পৃথিবী ও মানবসমাজের উন্নতি।
সহোদরদের সম্পর্কগুলো নির্ভর করে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর। অর্থনীতি ভালো তো, একই মাএর সন্তানদের মধ্যে সম্পর্কও ভালো। আবার অর্থনীতি খারাপ তো সম্পর্কও খারাপ। এর ব্যতিক্রম কি নেই? বড়লোকের ছেলেরা কি একে অপরকে গুলি করে মারে না? মারে। আমি এই মারামারি কাটাকাটিকে সম্পর্ক ভালো-খারাপের সূচক হিসেবে ধরছি না। আমি হৃদ্যতার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছি। আর ভালো অর্থনীতি ছাড়া বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানবিক থাকা যায় না। ভাই-ভাই বা ভাই-বোনের সম্পর্কও এর বাইরে নয়। কিন্তু এই সম্পর্কের ইতিবাচক দিকটি হচ্ছে, জীবনের শুরুতে একই পরিবারে এবং একই পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠার কারণে সহোদরেরা সহজেই নিজেদের অর্থনীতিকে ধারণ করতে পারে। ফলে সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাওয়ার কারণটি তারা সহজেই বুঝে ফেলে এবং প্রয়োজনীয় অভিযোজনের মাধ্যমে বেঁচে থাকার উপায়টি বের করে নেয়। এজন্যই কখনো প্রয়োজন হলে; এক ভাইএর সম্পদ যদি বেড়ে যায়, তাকে বাদ দিয়ে অন্যজন বা অন্যরা অনায়াসেই জীবন ধারণ করতে পারে। আবার কখনো কখনো কম সম্পদের মালিক সহোদর বা সহোদরদের প্রতি প্রয়োজনীয় দরদটুকুও দেখাতে পারে ধনীজন বা ধনীজনেরা।
তো আমার যেটা ধারণা সেটা হচ্ছে, সম্পর্ক আসলে খুবই স্বল্পমেয়াদী একটি বিষয়। কথাটাকে দুই মাত্রায় বিবেচনা করতে হবে। সম্পর্ক আসলে প্রায় ভিত্তিহীন, কেননা কোনো না কোনো স্বার্থ এর পেছনে জড়িত থাকবেই এবং সম্পর্ক আসলে প্রায় অর্থহীন, কেননা কেবলমাত্র স্বার্থ সংরক্ষণের ক্ষমতার ওপরেই এটি টিকে থাকবে। অর্থাৎ স্বার্থ সংরক্ষণের ক্ষমতা যার যত বেশি, সে সম্পর্ক রক্ষায় তত বেশি পারদর্শী। রান্ডম টু রান্ডম সম্পর্কগুলোও আমার কাছে স্বার্থান্বেষী মনে হয়। নিঃস্বার্থ উপকারের পেছনেও একটা স্বার্থ থাকে। মানুষ মনে মনে কামনা করে, নিঃস্বার্থ উপকারটির কথা অপরপক্ষ মনে রাখুক। অনেকে আবার অন্যত্র গল্প করার সময় সেটি বলেও ফেলেন।
মানুষ নামক জাতিটি আসলে কম ভয়ংকর নয়। আমার মানুষ না হয়ে অন্য কিছু হতে আপত্তি ছিলো না। অন্য কিছু না হয়ে মানুষ হয়েছি তাতেও খুব বেশি আপত্তি করছি না। তবে কিছুটা বিরক্ত হয়েছি ঠিকই। ওস্তাদের সঙ্গে যে কারণে আমার আজীবনের দুঃসম্পর্ক। এছাড়া আর কারো সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ কারো প্রতি কখনো স্বার্থ সংশ্লিষ্ট টান অনুভব করি নি।
No comments:
Post a Comment