বাংলাদেশের যে কয়টি দৃশ্য আমাকে খুব কষ্ট দেয় তার একটি হল
রাস্তায় ঘুমন্ত মানুষ। ফার্মগেটের ওভার ব্রিজে প্রায় দেখি অর্ধেক শরীর রেলিঙের
বাইরে রেখে ঘুমিয়ে আছে। একটা বাতাস এলেই ধুপ করে নিচে পরবে। আমি প্রায় সময় উপর
থেকে নিচে তাকিয়ে তাদের ব্রিজ থেকে পরে যাবার দৃশ্যটি কল্পনায় এনে আঁতকে উঠি।
শহরের রাস্তার যেখানটায় আমরা থুতু ফেলি রাত হলে সেখানটাতেই
কোন কোমল শরীর আলতো করে শুয়ে থাকে; এর চেয়ে স্পর্শকাতর ব্যাপার
আমাদের জন্য আর কী হতে পারে?
কেন এত মানুষ রাস্তায় ঘুমায় ; এই প্রশ্নটির উত্তর আমি
খুঁজে পেয়েছি। তাদের প্রতি আমাদের যে আবেগ তার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, তাদের অধিকাংশ স্বভাবের
কারণে রাস্তায় থাকে।
এক গ্লাস পানিতে একটু লেবু চিপে চিনি নাড়িয়ে দিলেই পাঁচ টাকা
দিয়ে বিক্রি করা যায়। প্রতিদিন দুশো গ্লাস বিক্রি হলে এক হাজার টাকা। খুব সামান্য
টাকা দিয়ে একটা ওজন মাপার মেশিন কিনে শিশু পার্কের সামনে বসে গেলেই হয়। স্টেশনে
শুয়ে না থেকে একটা ফ্লাক্স কিনে রাস্তায় চা বিক্রি করলেই হয়।
এক হাজার টাকা দিয়ে যে কোন একটা বস্তিতে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকা
যায়। অর্থাৎ সে ইচ্ছে করলেই তার দু দিনের পারিশ্রমিক দিয়ে ফুটপাতে না থেকে একটা
বাসা ভাড়া নিয়ে সুন্দর করে থাকতে পারে। তবু এই কাজটি সে করবে না। কেননা সে অলস।
....একদল মানুষ নির্মাণাধীন
ভবনে ইট ভাঙ্গবে, রোদে
পুড়ে উদাম গায়ে ঠেলাগাড়ি ঠেলবে এবং আরেকদল মানুষ এই কাজটি না করে রাস্তার মাঝখানের
আইলেনে শুয়ে থাকবে। এবং কোন সাংবাদিক সেই করুণ ছবি তুলে করুণার ক্যাপশন দিবে! এটা
বোধহয় অন্যায় !
কিছুদিন আগে আমি মসজিদ থেকে বের হয়ে দেখি দুজন চটপটি বিক্রি
করছে। একজন ঝালমুড়ি। অন্যএকজন যুবক ( সুস্থ সবল) কিছু না করে ভিক্ষা করছে। আমি
কিছুটা দূরে দাড়িয়ে তাদের লক্ষ করেছি। একদম গরমে ঝালমুড়ি এবং
চটপটির ক্রেতা না থাকলেও দু একজনকে দেখলাম সুস্থ সবল ছেলেটিকে সাহায্য করছে। আমার
কাছে মনে হল ব্যাপারটি অন্যায়।
যে ছেলেটি এই রোদে কষ্ট করে ঝালমুড়ি বিক্রি করছে ঠিক তার মতই
আরেকটি ছেলে ভিক্ষা করছে। তার কাছে মনে হতেই পারে, সে তার কাজের স্বীকৃতি পায়
নি। তার মনে আসতেই পারে এর চেয়ে ভিক্ষা করলেই হত !
প্রায় সময় জুম্মা নামাজ পড়ার পর দেখবেন বাইরে অনেকে ( যারা
প্রতিবন্ধী না ) ভিক্ষা করছে। আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন এই লোকগুলো মসজিদের সামনে
এসে নামাজ না পড়ে আল্লাহু আল্লাহু বলে শব্দ করে আসলে আপনাকে ধোঁকা দিচ্ছে।
মাত্র দুটি জিনিস সৃষ্টিকর্তা পছন্দ না করা স্বত্বেও অনুমতি
দিয়েছেন। একটি ডিভোর্স অন্যটি ভিক্ষা।
আমাদের ফোকাস ফেলতে হবে অন্য একটি জায়গায়।
ফার্মগেটের ওভার ব্রিজে অর্ধেক শরীর রেলিঙের বাইরে রেখে যে
যুবক ঘুমিয়ে আছে সে ইচ্ছে করলেই একটা টিনের বাসায় ফ্যান ছেড়ে ঘুমাতে পারে। কিন্তু
বিবিএ পাশ করে যে ছেলেটি চাকরী না পেয়ে ফ্রাস্ট্রেশনে ভুগছে; ইচ্ছে করলেই সে পানিতে লেবু
চিপে রাস্তায় দাড়িয়ে যেতে পারে না।
সংখ্যায় এরা প্রচুর। কি পরিমান মানসিক কষ্টে তারা আছে সেটা
আমি জানি। তাদের পরিপাটি শার্ট প্যান্ট আপনাকে তাদের অর্থ কষ্টের কথা বুঝতে দেবে
না। একদম দেবে না।
এটা কোন শীতে কম্বল কালেকশনের ইভেন্ট না যে সবাই মিলে একটা
কিছু করে ফেলব। লক্ষ লক্ষ বেকার যুবকের বছরের পর বছর খালি পকেটের দায়িত্বটা যাদের
তারা কেউ কথা রাখে নি।
কথা রাখে নি সরকার। বিরোধীদল। হিউম্যান রাইটস, শিল্পপতি , এনজিও... কেউ কথা রাখে নি।
যাদের কাছ থেকে আমরা কিছু আশা করি... যাদের জন্য বেঁচে থাকতে
ইচ্ছে জাগে সেই সব বুদ্ধিজীবীরাও কথা রাখে নি। বড় বড় গায়ক , ক্রিকেটার , লেখক , অভিনয় শিল্পী সবাই মিলে কী
কিছু একটা করা যেত না ?
সংখ্যায় এরা প্রচুর। এদের বাদ দিয়ে ' এবার নতুন কিছু কর' , ' জেগে ওঠো আপন শক্তিতে ' এই সব স্লোগান দিয়ে কী হবে ?
মধ্যবিত্তরা তাদের কষ্ট বুকের ভেতরে রেখে শার্টের বোতাম
লাগিয়ে রাখে। মানুষ তার গোপন কষ্টের কথা কাউকে বলতে চায় না। আবার বলতে চায়। খুব
বলতে চায়।
No comments:
Post a Comment