ইদানিং এসফল্টের রাস্তায় ছোপছোপ রক্ত দেখতে পাই। কুয়াশা মাখা সোডিয়াম সোনালী আলোয় হাঁটতে হাঁটতে যতবারই এগিয়ে যাই, রক্তের ছোপ গুলো দূরে সরতে থাকে। আর সেখান থেকে জন্ম নেয় ঘিনঘিনে পোকারা।
কি খবর হে? দিনকাল কেমন যায়।
কে যেনো পাশ থেকে জিজ্ঞেস করলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে খুঁজে পাইনা। এমনকি ঘিনঘিনে পোকাগুলোও নেই পায়ের আশে পাশে। শুধু দু’টো চালক ছাড়া ভ্যানগাড়ি সাঁতার কেটে যায় কুয়াশার সরোবরে। তাদের পিঠে হাতির শুড় আর গন্ডারের শিং দিয়ে বোঝাই করা ঝুড়ি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সোনালী অন্ধকারে হারিয়ে যায় ভ্যানগুলো। এসফল্টের নদীতে ডুবসাঁতার দিতে থাকা একটা ছিপছিপে কিশোরী হঠাৎ মাথা তোলে। তার চোখে লাল রঙের কাজল, ঠোঁটে গাঢ় নীল লিপস্টিক। যে কেউই সেটাকে কালো বলে ভুল করবে। কিন্তু আমি ভুল করি না। আমি লাল কে লাল, আর গাঢ় নীল কে গাঢ় নীল হিসেবেই সনাক্ত করতে পারি। শাঁই শাঁই করে চাবুকের শব্দে মাথা তুলে দেখি শেরাটনের সামনের ঘোড়ার গাড়িটা নেমে এসেছে পথে। লাল কাজল আর গাঢ় নীল লিপস্টিক দেয়া কিশোরীটা চেপে বসে সেই ঘোড়ার গাড়িতে। তাকে নিয়ে গাড়িটা প্রবল গতিতে ছুটে যায় মিন্টো রোডের সবুজ অন্ধকারের দিকে। আমি সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকি। বারডেমের কাছে পৌছুতেই ওভারব্রীজটা আড়মোড়া ভাঙ্গতে থাকে আর ব্যাথাতুর শব্দ করতে থাকে।
এবার আমিই ব্রীজটাকে জিজ্ঞেস করি
- কি খবর হে? দিনকাল কেমন যায়?
ব্রীজটা তিন-ছয় ফোঁটা লুব্রিকেটিং অয়েল (পরে বুঝেছি ওটা ছিলো ব্রীজের অশ্রু) ঝরিয়ে বলে
= না হে, পেটে বড় যন্ত্রনা।
আমি উৎসাহী প্রশ্ন ছুঁড়ে দেই
- কেনো কেনো?
ব্রীজটা উত্তর দেয়
- বালের ছোটোলোকদের জ্বালায় কি আর সুখ থাকে? সারারাত ধরে আমার পেটের ভিতর শুয়ে শীতে কাঁপাকাপি করে।
আমার মেজাজটা কেনো জানি খারাপ হয়ে যায়।
‘একটা হাড়ের ছুরি’
চিৎকার করতে করতে ছুটে যাই সামনের দিকে।
বামে মোড় নিতেই দেখি আরেকটা ওভারব্রীজ আমার পথ আটকাবার পাঁয়তারা করছে। আমি কান্নি মেরে বেরিয়ে যাই, পিছনে ওভারব্রীজটার হাউমাউ করে কেঁদে ওঠার শব্দ শুনি। আমার এখন মেজাজ খারাপ। কারো কান্না শুনার সময় হাতে নাই। সামনে এগিয়ে হাঁফাতে থাকি। এই সব দৌড়ঝাঁপের বয়স কি আর আছে? তারপর আবার হাঁটা শুরু করি।
শিশুপার্কের ফেরিস হুইলটা দেখলাম খুব ভাব নিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে।
‘থাক না বেটা ভাব নিয়ে, তোর ভাবে আমার বয়েই গেছে’
ভাবতে না ভাবতেই দেখি ঢাকা ক্লাবের গেটে দাঁড়িয়ে আছে সেই ঘোড়ার গাড়িটা।
ঐ যে যেই গাড়িটা দিনের বেলা দাঁড়িয়ে থাকে শেরাটনের সামনে, রাতের বেলা লাল কাজল আর গাঢ় নীল লিপস্টিক মাখা কিশোরীদের নিয়ে ছুটে যায় মিন্টো রোডের সবুজ অন্ধকারে। গাড়িটা সুস্থ্যই আছে, কিন্তু ঘোড়া দু’টোকে দেখলাম টলতে টলতে বেরিয়ে আসছে ক্লাবের গেট দিয়ে। বেশ স্যুট টাই পড়ে নিয়েছে কখন জানি। তাদের সাথে আছে এসফল্টের নদীতে সাঁটার কাটা লাল কাজল আর গাঢ় নীল লিপস্টিক মাখা সেই কিশোরীটা। দু’টো ঘোড়াই তাদের চারটে পা কিংবা চারটে হাত দিয়ে কিশোরীটাকে ধরতে চাইছে। এ যদি কিশোরীর উঠতি স্তন ধরছে, তো ও ধরছে নিতম্ব। এরকম হেঁচড়াহেঁচড়িতে একজন হ্যান্ডসাম ঘোড়ার সম্পত্তি হ’লো কিশোরীর স্তন, আরেক জনের কাছে জমা হ’লো কিশোরীর নিতম্ব। ঘোড়া দু’টো, সব পাওয়া হয়ে গিয়েছে মনোভাব নিয়ে সেই লাল কাজল আর গাঢ় নীল লিপস্টিকের কিশোরীটাকে ছুঁড়ে দিলো লেজের ঝাপ্টায়। সে মুখ থুবড়ে পড়লো আমারই পায়ের কাছে। আমার ভেজা চোখের দিকে তাকিয়ে গাঢ় নীল হাসি হাসতে হাসতে কিশোরী আমাকে বলল
‘সব লইয়া গ্যাছে দেইখা মন খারাপ কইরোনা। রাইতে আইসো সোনা, সব নয়া পাইবা...’
বলেই খিল খিল শব্দের সাথে সে একটা ঘিনঘিনে পোকা হয়ে গেলো।
তারপর
সব শুনশান।
শুধু রমনার লেকটা আমাকে ঘুমিয়ে পড়ার জন্য পরম মমতায় ডাকতে থাকলো। কেনো জানি না আমারো মনে হচ্ছিলো, রমনার লেকটাই আমার মা। আর আমার এখন মায়ের কোলেই ঘুমুতে যাওয়া দরকার।