বড় আপা যেদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়, সেদিন আমি স্কুল ছুটির পর বাড়ি আসার পথে, একটু পর পর সবাই ডেকে জিজ্ঞেস করছিলো,
- কিরে মামুন তোর বইন নাকি ভাইগা গেছে! হেড মাস্টরের মাইয়া এমুন কাম করল কেমনে!
ক্লাস সিক্সে পড়ুয়া আমি ভেগে যাওয়ার অর্থ কি, সেটা না বুঝলেও, কিছু একটা হয়তো গন্ডগোল হয়েছে, এটা বেশ বুঝতে পারলাম।
আমার আব্বা, কনকপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল মতিন, বারান্দায় চেয়ারে ঠাঁয় বসে ছিলেন। আব্বা শান্ত দৃষ্টিতে শূন্যে তাকিয়ে ছিলেন।
আব্বার পাশে যেয়ে দাঁড়াতেই, আব্বা বললেন,
-ঘরে যাও আম্মার কাছে।
আম্মার ঘরে ঢুকে দেখি, আম্মা ডুকরে কাঁদছেন, আর বিলাপ করে বলছেন,
- মিলির বাপ, আমার মাইয়াটারে আইন্যা দাও।
পাশের বাড়ির জমির চাচা আপাকে শেষবার দেখেছিলো বাস স্ট্যান্ডে, কোন নাকি এক ছেলে ও ছিলো সাথে, চাচা ডাক দিতে দিতেই বাস ছেড়ে যায়। সেই পরে আব্বাকে এসে সব জানায়!
আপার কলেজ, যাওয়ার পথের রাস্তা, যেখানে যেখানে পারা যায়, পরের কয়দিন অনেক খোঁজা-খুঁজি করা হলো আপাকে, মেঝো আপাকেও আব্বা রুমে নিয়ে কি জানি জিজ্ঞেস করলেন, আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না।
ঐদিনের পর থেকে বাড়ির চিত্র বেশ পাল্টে গেলো। আগে বড় আপা, মেঝো আপা, আমি একসাথে সকালের নাস্তা করতাম। সন্ধ্যাবেলা বাড়িতে বসতো আড্ডামহল, আব্বার বাড়ি ফেরার গলা খাঁকারি শুনতে পেলে তিন ভাই বোন পড়ি মরি করে দৌঁড়ে পড়তে বসতাম।
রাতে আম্মা আর আমরা তিন ভাইবোন মিলে, কতো আলাপ, কতো গল্প। আব্বা ছিলেন বেজায় রাগী, আব্বার পাশ মাড়াতাম না কখনো আমরা। দারুন সেসব সোনালী দিন।
প্রায় দিন পনের পার হয়ে গেছে, বড় আপার কোনও হদিস নাই। আমার রোজ আপার জন্য কান্না পায়, বড় আপা আমাকে রেডী করে দিতো, নাস্তা খাইয়ে দিতো, রাতে ঘুমানোর সময় মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো, মেঝো আপার সাথে আমি ঝগড়া করলে, আমাদের মিটমাট করে দিতো। খাওয়ার পর হাত ধুয়ে আমি আপার ওড়নায় হাত মুছতাম, যেনো ওতেই আমার শান্তি ছিলো।
সবার সবদিকে বড় আপার বিরাট খেয়াল ছিলো, সব নিজের হাতে সামলাতো। তবুও মাঝেমধ্যেই দেখতাম রাতের বেলা বড়আপা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করে। কিসের দূঃখ বোঝার ওতো ক্ষমতা আমার ছিলো না।
বড় আপা যেদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়, তার আগের রাতে আমাকে আর মেঝো আপাকে ধরে সে অনেক কান্না করেছিলো। তখনও বুঝিনি আমার মায়ের মতো আপা এভাবে সবাইকে কাঁদিয়ে কারো সাথে চলে যাবে।
আপার পালিয়ে যাওয়ার পর, আমাদের রীতিমতো সব জায়গায় হেনস্তা হতে হতো। স্কুলে গেলেই ছোট-বড় ক্লাসের সবাই বলতো, " ঐ দেখ ভাইগা যাওয়া মিলির ভাই আইছে"।
আব্বার সাথে একদিন বাজারে যাওয়ার পর, মুদি দোকানি চাচা, মাল ব্যাগে ভরে দিতে দিতে বললেন,
- বুঝলেন হেড স্যার, খালি দুই অক্ষর পইড়া পাশ দিলেই মানুষ অয় না। আপনের মতো এমন সম্মানী ব্যাক্তির মান-সম্মান ভাবলো না মাইয়া! এই কলঙ্ক কই রাখবেন??
পাশ থেকে আরেক জন বলে উঠলেন,
- তা পোলাডা, আইতো নাকি বাইত্যে মাঝেমইধ্যে???
সে রাতে আব্বাকে আমি জীবনের প্রথম হাউমাউ করে কাঁদতে দেখি!
আপা যাওয়ার পর থেকেই আম্মা শয্যাশায়ী। এতো বড়মানুষি সব কিছুর মধ্যে আমার খুব একলা একলা লাগে, মেঝো আপার সাথে আমার আর ঝগড়া হয়না। আমার খালি, বড় আপার কাছে যেতে ইচ্ছে করে, আবার রাগ ও হয়! আপা পালিয়ে না গেলে, কেউ আর আমাদের কোনও কথা শুনাতে পারতো না। আম্মা সুস্থ হয়েই থাকতো, আমার ওমন শক্ত সামর্থ্য আব্বা এরকম মনমরা হয়ে থাকতেন না।
...............
৮/৯ বছর কেটে গেলো, এতো দিনে এটা বেশ বুঝতে পেরেছি, মান সম্মান একবার হারালে, সেটা আজীবন বয়ে বেড়াতে হয়। মধ্যবিত্তের মান-সম্মান ই সব।
বড় আপার কথা আমার আর মনে হয়না। খুব ঘৃণা হয়, কি নিদারুণ কষ্ট আমরা পেয়েছি তার জন্য। আমাদের আম্মাকে হারিয়েছি, আম্মা বড় আপার শোকেই মারা গেলেন। এতো স্বার্থপর সে, কোনও খোঁজ খবর অব্দি নেয়ার প্রয়োজন মনে করে নি। সাজানো সংসার টা বড় আপার জন্য মাটিতে মিশে গেলো।
আব্বা এতোদিনে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছেন, এবার ঠিক করেছেন, মেঝো আপার বিয়ে টা দিয়ে দিবেন।
যত সমন্ধই আসে, বড় বোন পালিয়ে বিয়ে করেছে শোনে সবাই পিছ পা হয়ে যায়। শেষমেশ, পাশের গ্রামের সৈয়দ বাড়ির ছেলের সাথে মেঝোআপার বিয়ে ঠিক হয়।
বিয়ে বাড়ির তেমন কোনও উচ্ছ্বাস নাই। আব্বা আমায় ডেকে নিয়ে বললেন,
- মামুন, তুমি সব সামলাও বাবা। আমি টাকা দিতাছি। কইয়ো কই কতো লাগে। আয়োজনে যাতে ঘাটতি না থাকে। একটাই মাইয়া আমার।
আপার বিয়ে উপলক্ষে সারা বাড়ি রং করা হলো, সব আত্মীয় স্বজন ও আসতে শুরু করলেন। ঠিক করা হলো, বাড়ির পেছনের বাঁশঝাড় টা পরিষ্কার করে ওখানে রান্নার আয়োজন করা হবে।
গায়ে হলুদের দিন সকাল বেলা, বাঁশঝাড় যখন পরিস্কার করা হচ্ছিলো, তখন ডেকোরেশন এর লোক চিৎকার করে সবাইকে ডাকছিলো,
- এনে কঙ্কাল, কঙ্কাল! এইগুলান কি!
দৌঁড়ে যেয়ে দেখি, মাটিতে পোঁতা, হাড়গোড় কঙ্কাল, আর মলিন হয়ে যাওয়া সালোয়ার, ওড়না, জামা।
পুলিশ কে খবর দিতেই, উনারা এসে সব উদ্ধার করলেন! কাপড়গুলো চিনি কি না জিজ্ঞেস করলেন।
এতো মলিন, কাপড় তাও আমার বুঝতে অসুবিধা হলো না, এটা আমার বড় আপার ওড়না!!!
পুলিশ, পূর্বের সব বৃত্তান্ত শুনে জমির চাচার বাড়িতে যায়, উনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে, যেহেতু তার ভাষ্যমতে, তিনিই সেদিন শেষবার আপাকে দেখেছিলেন, বাসস্ট্যান্ডে।
কিন্তু জমির চাচা দুপুর থেকে পলাতক!!
জমির চাচা পলাতক আজ ৩দিন ধরে।তার বাড়িতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে সে হঠাৎ করেই বাড়ি থেকে কিছু টাকা নিয়ে কোথায় যেন চলে গেছে ।
এমনকি ফোনটাও সাথে করে নেয়নি! দেখতে ও নাকি খুব চিন্তিত লাগছিল।
এসব জানার পর পুলিশ এর সন্দহের পরিমাণ বেশি বেড়ে গেছে। অপরদিকে আপার ক'ঙ্কাল এর হা'ড়গুলো আর ঐ কাপড় গুলো পরিক্ষা করে রিপোর্ট তৈরি করতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।আমরা আপাকে ভুল বুঝে এসেছি এতদিন। কতটা অপবাদ দিয়ে এসেছি। অথচ সেই এই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে একবার ও মনে হয়নি।
বাবার মান-সম্মান গেছে ভেবে সবার আলাদা একটা ঘৃনা হচ্ছিল তার উপর।
সে আমাদের এত ভালোবাসা দিয়ে আগলে রেখেছে।
আপার সাথে এত বড় অন্যায় করা হয়েছে বিন্দু পরিমাণ টের পাইনি আমরা। আপা নির্দোষ ছিল!
৮বছর আগের স্মৃতি আবার নতুন করে জেগে উঠেছে
সেই কষ্ট নতুন রুপে মারাত্মক আকারে প্রকাশ পেয়েছে।
শুধু মন বলছে আপা তুমি নির্দোষ! আপা তুমি খুব ভালো ছিলে। আপা কেন চলে গেলে??
কেন এ অন্যায় হলো তোমার সাথে!?
বিয়ে বাড়ীতে মুহূর্তেই শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
আমাদের পরিবারের সবাই কাঁদছে! প্রতিবেশীরা এসে
ভীড় করছে বাড়ির আঙিনায়।
যে করেই হোক আমার আপার খু'নি কে শাস্তি দিতে হবে!
আমার মেজো আপার বিয়ে টা কোনো রকম দিয়ে মেহমান বিদায় দেয়া হলো!
মহল্লায় সবার মুখে অসহায় আর দুঃখের ছাপ পড়ে আছে ।
অথচ এই মুখেই তারা আমাদের পরিবারের সদস্যদের অপমান করতে দ্বিধা করেনি আপা নিখোঁজ হওয়ার পর!
আজ সকালে মেজো আপা , দুলাভাই এবং আমি আর ভাইয়া থানায় গিয়ে মামলাটা
আরো জোড়ালো করে এসেছি। কারন আমার আপার খুনির মৃ'ত্যু'দণ্ড চাই আমরা।
আমাদের কে সাহায্য করতে গ্রামের কয়েকজন নেতা ও
পুলিশ কে বলে দিয়েছে সেজন্য আরো কিছুটা ভরসা পেলাম!
পুলিশ বাড়ীতে এসে ঐ দিনের সকল ঘটনা আমাদের থেকে বিস্তারিত শুনলেন
এবং জমির আমাদের বাসায় মাঝে মাঝে আসতো কোনো কারণ ছাড়াই এটাও জেনে নিলেন।
আপার রিপোর্ট প্রকাশ পেয়েছে আমাকে মাথায় প্রচন্ড জোরে আ'ঘাত করে মারা হয়েছে।
আর সাথে ধ'র্ষ'ন ও করা হয়েছে।
পুলিশ সকল প্রকার প্রমানের উপর ভিত্তি করে জমির চাচাকেই দোষী সাব্যস্ত করলো।
এবং প্রত্যেক টা জেলায় তার ছবি পাঠিয়ে তল্লাশি চালিয়ে গেলো।
অপরদিকে আমাদের বাস স্ট্যান্ড এ খবর নিয়ে জানা গেছে এই লোক যায়নি আর যেহেতু দুরে কোথাও যাওয়ার একমাত্র পথ ট্রেন ছিলো
তাই সেখানেই খোঁজ করলো,
স্টেশন এ যেতে ইজিবাইক ভ্যান চালক দের কাছে ছবি দেখিয়ে খোঁজ নেয়া হলো।
সেখানে কেউ দেখেনি তাই
প্রতিটি টিকিট কাউন্টারে খোঁজার চেষ্টা করলে জানা গেছে সে যশোরে গেছে বেলা ১১টায় ছেড়ে গেছে ট্রেনটি!
পুলিশ যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলায় জমির এর সকল ডিটেলস দিয়ে দিয়েছে এবং
সেখানে থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং আমাদের জেলার কোর্ট এ চালান দেয়!
প্রথম জিগ্গেসাবাদে কোনো ধরনের তথ্য পাওয়া যায়নি তাই ২দিনের রি'মান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
এবং জানা যায় উনি ই সেই নিষ্ঠুর খু'নি ! আমার আপাকে নির্মম ভাবে হত্যা করেছে!
ঐদিন সকালে আপা যখন পুকুরে হাত মুখ ধুয়ে
বাসায় আসছিল তখন নাকি সে পায়ে ব্যাথা পাওয়ার অভিনয় করে!
এবং আপাকে তার ঘরে পৌঁছে দিতে বলে ।
আপা শয়তানের ফাঁদে এ পা দেয়!
(তখন কার ঘটনা)
আপা:চাচা আপনি ব্যাথা পেলেন কি করে?
জমির: গাছের শিকড়ের সাথে ধাক্কা লেগে রে!
আপা: আহারে! অনেক টা ব্যাথা পেয়েছেন!এই তো পৌঁছে গেছি এবার আমি আসি চাচা।
(জমির আপার হাত টেনে ধরল)
জমির:আরে কোথায় যাও দাঁড়াও এই বলে দড়জা বন্ধ করে দিলো অপর হাতে!
আপা:চ--চা-চাচা আপনি না হাঁটতে পারছিলেন না তখন?!(কান্না আর ভয়ে)
জমির: তখন পারিনি তো এখন তো পারি আরো কত কি পারবো সোনা দেখো শুধু (ঘোড় লাগা বিচ্ছিরি ভাবে)
আপা:এসব কি কি ব-- বলছেন?
জমির: অনেক দিনের আশা ছিল তোকে কাছে পাওয়ার আর আজ না পেলে তো তুই চলে যাবি আবার শশুর বাড়ি তাই আর সময় নষ্ট করতে চাই না।
এই বলে আপার উপর পাষান্ড টা ঝাঁ'পিয়ে পড়ে আপা হাত পা ছুড়তে ছুড়তে এক সময় স্থীর হয়ে যায়।
অবশেষে আপার মাথায় পাশে থাকা শিল দিয়ে আ'ঘাত করে আপার প্রান পাখি টা উড়ে যায়।
বাইরে এসে আপার নামে অপবাদ রটায় আর সেই
রাতে মাটি চাপা দিয়ে আসে!
এতক্ষণ ধরে সবাই এই নির্মম কাহিনী শুনছিলাম বুকটা ফেটে যাচ্ছে কষ্টে!
সবকিছু শুনে বিচারক হ'ত্যা ও ধ'র্ষ'ণের অভিযোগে তাকে ৩দিন পর ফাঁ'সির রায় ঘোষণা করেন!
খুনি কে শাস্তি দিতে পেরে প্রশান্তি আর বোন হারানো এক বুক কষ্ট নিয়ে বাড়ি ফিরছি।
No comments:
Post a Comment