অনামিকা,
“ তুমি নেই বলে,দুপুরগুলো বিষণ্ণ
চার দেয়ালের মাঝে,আটকে
থাকা আমার জন্য
তুমি নেই রাতে,তারাদের
ঘুমগুলিতে
ল্যাম্পের নিভু আলো,হলদে
রাঙ্গা পথে ... “
অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করছে
তোমার সাথে। মনের মাঝে জমানো অনেক কথা,
অনেক ঘটনা, অনেক গল্প বাকি রয়ে
গেছে এখনও। অনেক কিছুই বলা হয়নি তোমাকে। সত্যি তো,
আমার সম্পর্কে কতটুকু জানো তুমি? আমার জীবনটা আসলেই
বইয়ে পড়া উপন্যাসের মত। জীবন আসলে উপন্যাসের জমজমাট কাহিনীকেও হার মানায় অনেক
সময়। গল্প উপন্যাসে যেটা হয়,
লেখক জীবনের এক বা একাধিক কাহিনী তুলে
এনে নিজের মত করে সাজিয়ে লেখেন। পাঠকের চাহিদা বা বইয়ের কাটতির একটা চিন্তা
তার মাথায় থাকে। অনেক লেখকের ওপর আবার চাপ থাকে প্রকাশকের। এত সব চিন্তা
মাথায় নিয়ে লেখক গল্পের সমাপ্তি টানেন। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই লেখাটা হয়
মিলনাত্মক। না হলে পাঠক কষ্ট পাবে মনে মনে। গল্প পড়ার পরেও একটা দুঃখবোধ
থেকে যাবে পাঠকের মনে। পাঠকের অবচেতন মন তাকে নির্দেশ দেবে এই লেখকের
লেখা এড়িয়ে যেতে। যেচে পড়ে কষ্ট পেতে কে চায়, বলো? অথবা লেখকের
জনপ্রিয়তা বাঁচিয়ে রাখতেই করতে হয় এই কাজ। কিন্তু বাস্তবতা অসম্ভব কঠিন। যে লেখক
অদৃশ্য কালিতে প্রতিটি মানুষের জীবন কাহিনী লেখেন, তার তো কোন
দায়বদ্ধতা নেই।
মনে করছো এত শত কথা কিভাবে জানি আমি? আমার জীবনটা তো এমনই, তুমি সেটা ভালই জানো।
সেই সকাল থেকে বেজে যাওয়া গানটার মতই আমার জীবনটা “চার দেয়ালের মাঝে,আটকে থাকা আমার জন্য”।
আমি অনেক ভাবি মানুষকে নিয়ে, মানুষের মন নিয়ে।
নিজেকে নিয়েও ভাবি, নিজের জীবনে করা ভুলগুলোর কথা ভাবি। অনেক সময় কি মনে হয় জানো? মনে হয় – আসলে আমরা শুধু মাত্র
সেই লেখকের তৈরি করা চরিত্র, আমাদের চারপাশে যা কিছু
ঘটে,
সব স্ক্রিপ্ট। আমরাই কেবল ভাবি যে আমরা
দৃশ্যপট বদলে দিচ্ছি। আসলে
কাহিনীটা সেভাবেই লেখা। আমাদের কিছুই
করবার নেই।
কিন্তু কি জানো, এই যে তৈরি করা স্ক্রিপ্টে আমরা অভিনয় করছি, সেখানে নাটক সিনেমার
অভিনেতাদের সাথে দারুণ একটা অমিল আছে আমাদের। ওরা কষ্টের অভিনয় করলেও
কষ্ট পায়না, তেমনি করে আনন্দের অভিনয় করলে আনন্দটাও পায় না। আমাদের
কিন্তু দুঃখ কষ্ট আনন্দ সব বাস্তব। এই যেমন তোমাকে সেই সকাল থেকে মিস করছি, সব কিছুই আছে আমার চারপাশে, নেই শুধু তুমি। আর তাতেই রঙ হারালো আমার পৃথিবী। এ কেমন শূন্যতা বলো তো?
আচ্ছা,
তোমারও কি এমন লাগে?
আজকে তোমাকে আমার ছেলেবেলার কথা
বলতে ইচ্ছে করছে। আর দশটা সাধারণ ছেলের মতই ছিল আমার শিশুকালটা। সাধারণ
মধ্যবিত্ত পরিবারের একটা ছেলের চারপাশে যা যা থাকে,
তার সবই ছিল আমার মাঝে।
অফিসের কাজে সদা ব্যস্ত বাবা, সীমিত টাকায় সংসার
চালাতে হিমসিম খাওয়া পুরোদস্তর গৃহিনী
মা, ছোট একটা বোন –
এসব নিয়েই ছিল আমাদের পরিবারটা।
স্কুলে পড়ার সময় উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের দামী দামী জিনিসপত্র, খেলনা দেখে আমারও
ইচ্ছে করতো সে সব পেতে। কিন্তু একটা
সময়,
খুব ছোট থাকতেই আমি কেমন করে যেন বুঝে
গিয়েছিলাম যে আমার বাবার এত
কিছু কিনে দেবার সামর্থ্য নেই। সে জন্য
তেমন কিছুই চাইতাম না আমি। স্কুল, বাসা আর আমার ছোট বোনটাকে নিয়েই ছিল আমার জগত। চাঁপা একটা
কষ্ট সে সময় ছিল কি না, আজ আর মনে নেই। কিন্তু এখন আমি জানি, সে সময় থেকেই নিজেকে
খুব অল্পতে সুখী করবার অভ্যাসটা গড়ে ওঠে আমার মাঝে। নিজের যা আছে
তা নিয়ে খুশী থাকা, কারও ওপর নির্ভর করার চাইতে নিজের ওপর নির্ভর করা, মন খারাপ হলে নিজের বানানো ধুসর পৃথিবীটাতে ঢুকে পড়াই আমার অভ্যাস ছিল।
ভালই ছিলাম আমি আমার
নিজস্ব জগতে। কেউ জানতো না ব্যাপারটা,
শুধু আমি জানতাম। মাঝে মাঝে যখন দিনে
দুপুরে আমার সেই জগতে ঘুরে বেড়াতাম,
তখন অনেকে বলতো – ভাবুক ছেলে, অমনোযোগী। আমাকে দিয়ে
পড়াশুনা হবেনা – এই কথাটা বাবা সোনার
অক্ষরে লিখে দিতে চেয়েছিলেন। আমার
কিন্তু একটুও খারাপ লাগতো না কথাটা
শুনে,
রাগও হতো না, দেখিয়ে দেবার ইচ্ছেও
হতো না। আমি তখন থেকেই জানি যে
আমি কতটুকু করতে পারি, আমার দ্বারা কতটা
সম্ভব। কিন্তু যেদিন স্কুলের
ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিশেষ বৃত্তি
পরীক্ষায় গোটা দেশের মধ্যে সেকেন্ড
পজিশন পেয়ে গেলাম, সেদিন বাবা হয়তো
অনেক খুশী হয়েছিলেন। কিন্তু কেন যেন
আমাকে আদর করেননি, বা বুকে জড়িয়ে ধরেন
নি, যেটা করা আমার এখন মনে হয় খুব স্বাভাবিক ছিল। আমাকে
অবশ্য মা বলেছিল যে আমি বৃত্তি পেয়েছি,
আর ওরা বেশ কিছু টাকা দেবে
আমাকে। সেদিন নিজের একটা ইচ্ছের কথা বলেছিলাম মা’কে। বলেছিলাম – মা, ঐ টাকা দিয়ে আমাকে সাইকেল কিনে দেবেন।
সেই সাইকেলটা অনেকদিন
চালিয়েছি, জানো। এক সময় অতি ব্যাবহারে সাইকেলের সিটটা ছিঁড়ে দিয়েছিল। সেখানে কাপড় দিয়ে বেঁধে সাইকেল চালাতাম।
যেদিন সেই বৃত্তি পরীক্ষার টাকা আনতে যাই ঢাকায়, বাবা মা কেউই যাননি
আমার সাথে। এলাকার এক বড় ভাইকে সাথে নিয়ে,
বাবার পুরনো একটা ব্রিফকেসে কয়েকটা
কাপড় নিয়ে সেই প্রথমবার আমি একা একা ঢাকা এসেছিলাম। যে প্যান্টটা
পড়ে স্টেজে গিয়েছিলাম, সেটার হুক ছিলনা,
কোন রকমে বেল্ট বেঁধে পড়তে হয়েছিল। মা
আমার সেই কথাটাও জানতেননা। আমার এই ছেড়া প্যান্ট নিয়ে বিস্তর
হাসাহাসি হয়েছিল সেদিন। স্টেজে আমার স্কুলের টিচাররা কেউ ছিলেন না, সবাই অপরিচিত মানুষ, মন্ত্রীও এসেছিলেন একজন। আমার হাতে খালি একটা খাম ধরিয়ে দিয়ে
সবাই মিলে ছবি তুলেছিল সেদিন। আমি শুধু তাকিয়ে দেখছিলাম, আমার সামনে যতগুলো বাচ্চা বসা, তাদের সবার বাবা মা,
নিদেন পক্ষে একজন অন্তত উপস্থিত ছিলেন। শুধু আমি ছিলাম একলা। ছবি তোলার পর আমার হাতে মাইক দিয়ে কিছু
বলতে বলা হলো। আমি কিছুই বলিনি,
আমি তো জানিনা এই সময় কি বলতে হয়। মা
তো শিখিয়ে দেননি আমাকে। ক্লাস থ্রিতে পড়া একটা বাচ্চা কিভাবে জানবে তাকে
স্টেজে উঠে কি বলতে হবে? কিন্তু সেদিন স্টেজ থেকে নেমে যে কান্নাটা কেঁদেছিলাম আমি, সেই কষ্টটা আজও আমাকে
ছুঁয়ে দেয়। বড় একা লাগে জানো, বড় বেশী একা লাগে।
ভাবছো এতসব কিভাবে মনে আছে আমার?
আমি নিজেও জানিনা, কিন্তু এসব কথা আমি ভুলতে পারিনা। পরদিন সকালের বাসে বাসায় ফেরার পথে প্রচণ্ড ঝড়
বৃষ্টি ছিল। আমাদের বাসটা এর মাঝেই চলছিল খুব দ্রুত গতিতে। মাঝে মাঝে
যাত্রীরা ড্রাইভারকে বলছিল আস্তে চালাতে। মাথায় ব্যান্ড বাঁধা ড্রাইভারটা
না কি খুব রাফ গাড়ী চালায়,
যাত্রীদের মুখেই শুনেছিলাম। আমি যতবার
আমার জগতটায় ঢুকতে যাচ্ছিলাম,
ঢুকতে পারছিলাম না কিছুতেই। কল্পনার
সুতোটা ছিঁড়ে যাচ্ছিল কান্নার তোড়ে,
বারবার। একটা সময় আমি মনে মনে
প্রার্থনা করছিলাম যেন বাসটা এক্সিডেন্ট করে,
আর আমি মরে যাই।
আমার প্রার্থনাটা সেদিন সত্যি হয়নি, দেখতেই তো পাচ্ছো।
কিন্তু একটা সত্যি আমি সেদিন বুঝে
গিয়েছিলাম – এই পৃথিবীতে আমি আসলে
একা। বাচ্চারা আর যাই বুঝুক বা না
বুঝুক,
অবহেলাটা বুঝতে পারে। সেই থেকে আমি আরও
গুটিয়ে গিয়েছিলাম নিজের
মধ্যে। নিজেকে আরও আড়াল করে নিয়েছিলাম
সব কিছু থেকে। স্কুলের মাঠে
খেলাধুলার চাইতে আমার বেশী ভাল লাগতো
স্কুলের ভেতরের গভীর কুয়োটার ধারে
গিয়ে বসে থাকতে। অনেকদিন সাইকেলটা
নিয়ে চলে যেতাম ঢাকা চিটাগাং হাইওয়ের
ওপর। একদিন দেখেছিলাম ট্রাকের চাপায়
মরে যাওয়া একটা দেহ। রক্তটা অনেকদিন
লেগে ছিল কালো পিচের ওপর। তারপর আস্তে
আস্তে মিলিয়ে যায়। আমি খুব চাইতাম
সেই জায়গাটাকে নতুন করে রাঙ্গাতে।
এরপর প্রায় তিন বছর কেটে গিয়েছে। ভালই ছিলাম আমি আমার নিজেকে নিয়ে। চাহিদাহীন, নিরাসক্ত জীবন। রোজ সকালে উঠে স্কুলে যাই,
স্কুল ছুটি হলে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াই, ক্লান্ত হয়ে গেলে বাসায় ফিরি। বাসা আমাকে টানেনা আর। বাসায় ফিরেই
দেখি সেই পরিচিত পরিবেশ। আমিই যেন অনাকাঙ্ক্ষিত সেখানে। এমন একটা সময়ে – নাহ, তোমাকে কেন, এই পৃথিবীর কাউকেই
বলা যাবে না সেই কথা। শুধু বলি, আমার চোখের
সামনে এমন একটা কিছু ঘটেছিল, যেটা আমার বাস্তব
জীবনটাকে তো অবশ্যই, কল্পনার
জগতটাকেও ভেঙ্গে চুড়ে শেষ করে
দিয়েছিল। মানুষের ওপর বিশ্বাস
হারিয়েছিলাম আমি তখনই। দিনের পর দিন
সেই অন্যায় আমার চোখের সামনে ঘটতে
লাগলো। যারা সেই অন্যায়টা করছিল, তারা হয়তো ভেবেছিল
এই ছোট্ট ছেলেটা ওসব বুঝবে না। অথচ আমি বুঝেছিলাম সবই। সে সময় আমি রাত জেগে
বিছানায় শুয়ে কাঁদতাম, প্রতিবাদ করতে পারতাম না।
পরবর্তী দুবছরে চোখের সামনে সেই ঘটনাটা,
সেই অন্যায়টা মাঝে মাঝেই ঘটে চললো। আর
সেটাই আমার জীবনটা পুরোপুরি পালটে দিলো। এক সময় স্কুলে বড় ভাইদের মুখে
শুনলাম যেসব ছেলেরা পড়াশুনা ঠিকমত করেনা,
তাদের হোস্টেলে ভর্তি করে দেয়া হয়।
যাতে তারা কঠিন শাসনের মধ্যে থাকে,
পড়াশুনা ঠিক মত করে। কাজেই পড়ালেখা
প্রায় বন্ধ করে দিলাম। পরীক্ষার খাতায় জানা প্রশ্নের উত্তরটাও
লিখতাম না। লক্ষ্য একটাই, আমাকে পালাতে হবে এখান থেকে। দূরে সরে যেতে হবে এই অসুস্থ
পরিবেশ থেকে। দূরে গিয়েও যদি একটু ভাল থাকা যায়। একসময় একজন
শিক্ষককে বলে কয়ে রাজী করিয়ে ফেললাম,
যেন উনি আমাকে হোস্টেলে ভর্তি করিয়ে
নেন। পরের মাসেই একটা ট্রাঙ্কে আমার যৎসামান্য জিনিসপত্র নিয়ে উঠে গেলাম
হোস্টেলে। পরিবারের মুক্ত পরিবেশ ছেড়ে হোস্টেলের বন্দি জীবনের মাঝে আমি
স্বাধীনতার স্বাদ পেলাম, প্রাণ ভরে বুক ভরে শ্বাস নেবার একটা ব্যবস্থা হলো আমার।
আমার যে সময়ে যেটা পাবার
কথা ছিল -ভালবাসা, যত্ন, মনোযোগ তার কোনটাই আমি
পাইনি। আমার ছেলেবেলাটা কেটেছে নিদারুণ
যন্ত্রণা আর অবহেলায়। আমি
স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে উঠতে পারিনি কখনই।
সে জন্যই আমি অন্যরকম। আমার কোন
কিছুতেই কোন কিউরিসিটি নেই, আবেগটা প্রকাশের
চাইতেই নিজের ভেতর রেখে নির্লিপ্ত একটা চেহারা আর মুখে হাসি ধরে রাখাই আমার অভ্যাস।
আমার কোন চাহিদাও নেই। যতটুকু দরকার,
যতটুকু না হলেই নয় – তা নিয়েই আমার জীবন
কেটে যায়। পৃথিবীর কাউকেই বিশ্বাস করতে পারিনা আমি। আমি জানি – আমার জন্য কারও কোন টান নেই, কারও আগ্রহও নেই। আমার শুধু আমি আছি। শুধু আমি আর আমার চারপাশে ঘিরে থাকা ধুসর শূন্যতা – এই নিয়েই আমার জীবন।
শূন্যতার বৃত্তে বন্দি আমার
জীবন কেটে যাচ্ছিল এভাবেই। এর মাঝে তুমি এলে,
আবারও এলোমেলো করে দিলে
আমার সব কিছু। আমার মনের দুর্ভেদ্য দেয়ালটাকে ভেঙ্গে একটু একটু করে শেকড়
ছড়ালে হৃদয়ের গভীরে। তুমি আমার ক্ষনিক দেখায় ভাল লাগা কেউ না। নিজের
মনকে অনেক শাষনে রেখেছিলাম, অনেক ভাবে আমার অন্ধকার মনে তোমার প্রবেশ ঠেকাতে
চেয়েছিলাম, তুমি কোন বাধাই মানোনি। একটা সময় আমার মনের ভেতরের সব সবুজ
গুলো মরে গিয়েছিল। অনেক বোধ,অনেক স্বাভাবিক
ইচ্ছে,কল্পনার কিছু বন্ধ কপাট খুলে যাওয়ার আনন্দ তোমার ছোঁয়ায়
অনুভব করলাম আমি। একটু একটু করে সবুজ হতে লাগলো বুকের ভেতরটা। দিনের
পর দিন, রাতের পর রাত কি এক অদ্ভুত ভাললাগা অনুভূতি নিয়ে বাঁচতে
লাগলাম আমি। নিজের জীবনটা একটু রঙ্গিন করতে মন চাইতো মাঝে মাঝে। খুব সকালে ঘুম
ভেঙ্গে গেলে মনে হতো তোমাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে আরও কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে
অনুভব করি তোমার সুবাস, তোমার উষ্ণতা। তোমাকে ভাবতাম সারাক্ষণ। এখনও ভাবি। তোমার জীবনটা ভরে দিতে ইচ্ছে হতো খুশী আর আনন্দ দিয়ে। এখনও আমার
প্রতি মুহূর্তের চাওয়া তোমার একটুখানি খুশী। কিন্তু কি করবো বলো। আমার জীবন যে
অভিশপ্ত। চোখের ওপর লেগে থাকা রঙের প্রলেপটা কেটে যেতে লাগলো একটা সময়।
রূঢ় বাস্তবতা আমাকে আবার আমার ধুসর পৃথিবীর দিকে টানতে লাগলো।
পালিয়ে যাবার চিন্তাটা প্রবল হয়ে উঠেছে কিছুদিন থেকে। অনেক ভেবে দেখলাম, এ জীবনে তোমাকে দেবার মত কিছুই নেই আমার। আমাদের সম্পর্কটা এখনও সেভাবে গড়ে
ওঠেনি। ফর্মাল কোন রিলেশনশিপে জড়িয়ে পড়িনি আমরা এখনও । এভাবে নিজের
অভিশপ্ত জীবনের সাথে তোমাকে জড়িয়ে তোমার পৃথিবীটাও আমি ধুসর করে
ছাড়বো একটা সময়। তোমার সামনে অনাগত রঙ্গিন ভবিষ্যৎ। আমি কি করে নিজে হাতে
সেই সোনালী সময়ের স্বপ্নটাকে ভেঙ্গে চুড়ে দেই বলো?
একদিন হঠাৎ করেই হারিয়ে যাব আমি
তোমার জীবন থেকে। এটাই আমার নিয়তি। আমি জানি,
আমাকে ছাড়া বাঁচতে শিখে যাবে
তুমি। প্রথমে কিছুদিন হয়তো একটু কষ্ট হবে। মাঝে মাঝে মনে পড়বে আমার কথা।
তারপর একসময় ভুলে যাবে। কোন এক রাজপুত্র আসবে তোমার জীবনটা রাঙ্গিয়ে
দিতে। আমি যেখানেই থাকি, একটা কথা জেনো,
আমি সব সময় তোমার জন্য প্রার্থনা
করবো।
ভাল থেকো।
অনন্ত
-------------------------------------------
চিঠিটা হাতে নিয়ে বসে আছে
অনামিকা। তার দুচোখ ভেসে যাচ্ছে জলে। অতীতের কোন একজনের করা একটা ভুল
অথবা অন্যায়, একটা মানুষের জীবনে কতখানি প্রভাব ফেলতে পারে, তার বর্তমান জীবনটা
ধ্বংস করে দিতে পারে, তা এই লেখা না পড়লে সে
কখনই বুঝতো না। অনন্তকে ফেরানোর ক্ষমতা
হয়তো নেই ওর। কোন বন্ধনও নেই
অবশ্য। নেই জোর করে ধরে রাখবার মত কোন
সম্পর্ক। ওদের মাঝে সুন্দর একটা
সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারতো। বিশ্বাস, নির্ভরতা, একে অপরের প্রতি
খেয়াল রাখা, কোন কিছুরই অভাব ছিল না ওদের মাঝে। দুজনেই ওরা চেষ্টা করতো
ছোট্ট ছোট্ট কারণ খুঁজে বের করে একে অন্যকে খুশী করবার। ভালবাসতো দুজনেই, তাই ওদের আবেগটা ছিল বিশুদ্ধ। হয়তো অনামিকা অপেক্ষায় ছিল সেই শুভ
মুহূর্তের, যখন অনন্ত তার হাত ধরে,
গলায় একরাশ আবেগ ঢেলে বলবে “তোমাকে ভালবাসি মেয়ে, অনেক ভালবাসি”। কিন্তু সে সময়টা আসবার আগেই আজকের এই
চিঠি। অনন্ত আর সবার চাইতে আলাদা, এটা বুঝতো অনামিকা। কিন্তু ওর ভেতরে এত কষ্ট, এত যন্ত্রণা লুকিয়ে আছে, সেটা কখনই ওকে বুঝতে দেয়নি ছেলেটা। বছরের পর বছর একটা মানুষ যখন নিজেকে এই কষ্টের মাঝ দিয়ে টেনে নিয়ে যায়, সময়ের গতিতে যখন সে বেড়ে ওঠে একটা শূন্যতা একটা হাহাকার বুকে নিয়ে, তখন তার অন্তরটা
পুড়ে পুড়ে হয়ে ওঠে
জ্বলজ্বলে, কঠিন কিন্তু বহুমূল্য
হীরের টুকরোর মত। তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনাটা অত্যন্ত কষ্টকর।
চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায় অনামিকা।
নাহ,সে এভাবে হার মেনে নেবে না কখনই। অনন্তকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনাটা কঠিন হবে,
কিন্তু অসম্ভব তো হবে না। অন্তত একবার
শেষ চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি?
ভালবাসা তো কত অসম্ভবকেই সম্ভব করতে
পারে। যেটুকু ওর অনন্তকে প্রয়োজন,
তার চাইতে অনন্তর অনেক বেশী প্রয়োজন
ওকে। অনন্ত নিজেও জানেনা সে মানসিক ভাবে বেশ খানিকটা অসুস্থ। অনামিকা যখন
তার মনের দুর্ভেদ্য দেয়ালটা ভাঙ্গতে পেরেছে, তখন ওর পক্ষেই
অনন্তকে স্বাভাবিক একটা জীবনে নিয়ে আসাটা সম্ভব। ভালবাসায় কি না হয়?
~সমাপ্ত~
No comments:
Post a Comment