কাজী সাহেবের গরুর কথা আমরা
সবাই জানি। তার কেতাবে যতটি গরুর উল্লেখ থাকে, গোয়ালে গিয়ে ততটি পাওয়া যায় না।
এক-দুই দিন নয়, সরেজমিনে অনেক দিন তদন্ত করে এমনটাই পাওয়া
গেল। তাই তার কেতাব এবং গোয়ালের গরুর হিসাবের বিষয়টা শেষ পর্যন্ত পরিণত হলো
প্রবচনে।
কাজী সাহেবের কেতাবে কয়টা গরুর
কথা উল্লেখ ছিল? গোয়ালে গিয়ে কয়টি পাওয়া গিয়েছিল? কোথাও এ প্রশ্নের
উত্তর নেই। কেতাব এবং গোয়ালে গরুর ব্যবধান যে রয়েছে সেটা যখন জানা গেল, তখন সংখ্যাটা গোপন করা হলো কেন? কাজী সাহেব সেটা
করতে সক্ষম হয়েছিলেন কীভাবে? সরেজমিনে যারা গণনা করতে
গিয়েছিলেন, তারাইবা হিসাবটা কেন গোপন করলেন? এসবের উত্তরও আমাদের জানা হয়নি কখনও।
আমরা জানি, বয়স ও লিঙ্গ ভেদে
গরু মূলত চার রকম। বাছুর, বলদ, ষাঁড় ও
গাভী। এ-সংক্রান্ত হিসাবের মধ্যেও কি কোনো ফাঁক-ফোকর ছিল না? নাকি বয়স ও লিঙ্গের বিষয়টি তারা ইচ্ছা করেই এড়িয়ে গেছেন? বাছুরকেও সাধারণ অর্থে ধরে নিয়েছিলেন গরু হিসেবে? ষাঁড়
ও গাভীর মধ্যেও পার্থক্য করেননি কি একই বিবেচনায়?
বলা হলো- কাজীর গরু কেতাবে
আছে, গোয়ালে নেই। অর্থাৎ গোয়ালে যে কয়টি গরু ছিল, হিসাবে
তার চেয়ে বেশি উল্লেখ করেছিলেন তিনি। এর পেছনে কী উদ্দেশ্য ছিল তার? নিজের মর্যাদা বৃদ্ধি? হতে পারে। এক কালে বলা হতো,
ধান হলো আসল ধন/আর ধন গাই,/সোনাতে কিছু আছে/
বাকি সব ছাই। এ অনুমান যদি ঠিকও হয়, তাহলে বলা যায়, কাজীর কেতাবে 'গাই'য়ের সংখ্যাই
ছিল বেশি। এ থেকে মনে আরও একটা প্রশ্ন জাগে, তাহলে কেন বলা
হলো না- কাজীর গাভী কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই? গোয়ালে 'গাভী' থাকলে দুধেরও
ব্যাপার-স্যাপার থাকে। সেই দুধ দিয়ে কী করা হতো? এত এত গরুর
দুধ তারা নিশ্চয় ফেলে দিতেন না? তাহলে দুধ নিয়েও কথা হতো।
কই কাজীর বাড়ির গাভীর দুধ নিয়ে তো কোনো কথা শোনা যায় না। সব দুধ কি বাছুরকে
খাওয়ানো হতো? তাহলে তো এ কথাও শোনা যেত- 'কাজীর গাভীর দুধ বাছুরে খায়'। এ কথা কি শোনা গেছে
কখনও?
গরুর হিসাবের তারতম্য যে কোনো
এক সময় প্রকাশ হতে পারে,
এমন বিবেচনা না করার মতো অবিবেচক ছিলেন না কাজী সাহেব। তিনি নিশ্চয়
চিন্তা করেছিলেন এ ব্যাপারে। কিন্তু তারপরও গরুর হিসাব দেখাতে চেয়েছিলেন প্রকৃত
সংখ্যার চেয়ে বেশি। সম্পদ বেশি থাকলে ট্যাক্সও বেশি দিতে হয়। এটাই সাধারণ নিয়ম।
তাই একালে সম্পদ গোপন করার প্রবণতা দেখা যায় অনেকের মধ্যে। আচ্ছা, সেকালে কি গরুর জন্য কর মওকুফ করা হতো? এখনও
গ্রাম-গঞ্জে দেখা যায়, যার গোয়ালে গরু যত বেশি তার ক্ষেতে
ধানও তত ভালো হয়। গরুর গোবর জৈব সার হিসেবে খুবই ভালো। অর্থাৎ
যাদের গরু আছে, তাদের মাধ্যমে উৎপাদনও হবে বেশি। সমাজকে ভিন্নভাবে বেনিফিটেড করবে তারা।
এমন কোনো চিন্তাও কি করা হয়েছিল সে সময়?
এ অনুমান যদি সত্য হয়, তাহলে কাজী
সাহেবকে কর ফাঁকিদাতা হিসেবে অভিহিত করা যায় নিঃসন্দেহে। কিন্তু সেক্ষেত্রেও
আরেকটি প্রশ্ন ওঠে। তিনি আসলে কী ধরনের 'কাজী' ছিলেন? সাধারণত দুই ধরনের লোককে 'কাজী' বলা হয়। এক. যিনি বিচার করেন
দুই. যিনি বিবাহ নিবন্ধন করেন। সেকালে বিচারকের মতো
গুরুত্বপূর্ণ পদে যিনি অধিষ্ঠিত ছিলেন, তার মতো লোক কর ফাঁকি দেবেন, এটা কি বিশ্বাস করা যায়? কলিকালে এসে মানুষের
নৈতিকতার অবনতি ঘটেছে ঠিক। কিন্তু সেটা তো আর কলিকাল ছিল না।
আবার দ্বিতীয়টা ধরে নিলেও
হিসাব মেলে না। বিবাহ নিবন্ধনের কাজ যারা করেন, সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে তাদের
ওঠাবসা। তাদের বাড়িতে সব ধরনের মানুষের যাতায়াত থাকে সব সময়।
প্রসঙ্গত এখানে একটি কথা বলা দরকার, রাতে গরু যে ঘরে রাখা হয় সেটাকেই শুধু
গোয়াল বলা হয় না; দিনের বেলা 'বেড়াহীন'
শুধু চাল কিংবা ছাউনি-যুক্ত যে ঘরে গরুকে রাখা হয়, সেটিকেও গোয়াল বলে। এ ধরনের ঘরে গরু আছে কি নেই কিংবা কয়টা গরু আছে,
তা সবার দৃষ্টি গোচর হয়। তাহলে কাজী সাহেবের পক্ষে গরুর হিসাব বেশি
দেখানোর উপায় ছিল না। নাকি তার গোয়াল একটাই গোয়াল ছিল? যেখানে
দিন কিংবা রাত নির্বিশেষে গরু রাখা হতো সব সময়? গরু দিন-রাত
এক গোয়ালে বেঁধে রাখার বিষয়টিকে 'অমানবিক'ই বলা যায়। সেকালে গরুকে যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ এবং সৌভাগ্যের প্রতীক
হিসাবে বিবেচনা করা হতো, সেহেতু এর সঙ্গে অমানবিক আচরণ করার
বিষয়টিও যুক্তিতে টেকে না। তাহলে?
কাজী সাহেব- তিনি বিচারক কিংবা
বিবাহ নিবন্ধক যেই হন না কেন, সমাজে তিনি ছিলেন গণমান্য। নইলে তার গরুর হিসাব এত গুরুত্ব পেত না। বড়ই ভালো মানুষ ছিলেন তিনি- এ
কথাও বলেন কেউ কেউ। কিন্তু তার গরুর হিসাব নিয়ে এত লুকোচুরি কেন, সেটা মেলানো যাচ্ছে না। কোনোভাবেই। তাহলে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসার পর যে কথাটি
প্রবচনে পরিণতে হয়েছে, তার ভিত্তি কী?
তথ্য বহুল আলোচনা
ReplyDelete