১.
কোনো পোস্ট টাইমলাইনে শেয়ার করলে কিংবা কোনো মেসেজ ফরওয়ার্ড করলে এর
বিনিময়ে ফেসবুক-কর্তৃপক্ষ কাউকে টাকা দেয় না এবং অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে
দেবে বলেও কোনো সম্ভাবনা নেই। ফেসবুক নামক সোনার-ডিম-পাড়া হাঁসটিকে
জাকারবার্গ আমাদেরকে মাগনা ব্যবহার করতে দিচ্ছেন, এই-ই বেশি। পোস্ট শেয়ার
করলে বা মেসেজ ফরওয়ার্ড করলে তিনি টাকা দেবেন— এই প্রচারে বিশ্বাস করা
চূড়ান্ত রকমের ছাগলামো। তাই, 'এই পোস্টটি শেয়ার করলে এই অসুস্থ ভাইটিকে
জাকারবার্গ শেয়ারপিছু এক ডলার করে দেবেন' কিংবা 'এই ছবিটা একজনকে পাঠালে
চিকিৎসার জন্য এই মেয়েটার অসুস্থ বাবা এক টাকা করে পাবেন'— এ ধরনের প্রচারে
বিশ্বাস করা থেকে এবং এ ধরনের ছবি শেয়ার ও ফরওয়ার্ড করা থেকে নিজে বিরত
থাকুন ও অন্যকে বিরত রাখুন। মনে রাখবেন, এসব পোস্ট বা মেসেজ যে তৈরি করে,
সে 'দেখি কয়জন বলদ এই ফাঁদে পা দেয়' ভেবে তৈরি করে এবং আপনি এসব শেয়ার বা
ফরওয়ার্ড করামাত্রই সে একটি করে তার কাঙ্ক্ষিত বলদ বা ছাগল পেয়ে যায়।
২.
ভুলভাল বানানে ধর্মীয় কিছু শব্দ বা বাক্যের শেষে 'এরিয়ে চোলে যেওনা
কিন্তু' লেখা মেসেজ ফরওয়ার্ড করলে সকালের মধ্যে কিংবা তিন দিনের মধ্যে
'সুখবর' পাওয়া যাবে এবং অবহেলা করলে বিবিধ গজব নেমে আসবে— এ ধরনের মেসেজ
প্রত্যেকের কাছেই কম-বেশি আসে এবং কিছু স্নাতকোত্তর মাকাল ফলও এই মেসেজ
ফরওয়ার্ড করে থাকে। যখন ফেসবুক ছিল না, তখনও মানুষ স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে
সুখবরের আশায় রূপকথা-সংবলিত কাগজ ফটোকপি করে বিলি করত। ইউএসএ চাঁদে গেছে
১৯৬৯ সালে, আর ২০১৭ সালে বাংলাদেশ বিশ্বাস করছে মেসেজ ফরওয়ার্ড করলে
'সুখবর' মিলবে, না করলে গজব নামবে!
৩.
কোনো পেজে বিখ্যাত কারো
মৃত্যুসংবাদ দেখামাত্রই রেস্ট ইন পিস কিংবা ইন্নালিল্লাহ-সহকারে শেয়ার করা
শুরু করবেন না। শোক প্রকাশ করতে একটু সময় নিন। গ্রহণযোগ্য জাতীয় দৈনিকগুলোর
ভেরিফাইড পেজে যান, টিভি চ্যানেলের স্ক্রল দেখুন। সেখানে যদি
সুনিশ্চিতভাবে মৃত্যুসংবাদ প্রচারিত হয়, সংবাদটি কেবল তবেই শেয়ার করুন।
শোকপ্রকাশে প্রয়োজনে ২৪ থেকে ৭২ ঘণ্টা সময় নিন, তবুও জ্যান্ত কাউকে মারতে
যাবেন না। এভাবে আমরা আর কতজনকে হারাব/ কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না, স্যার/
যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন— এ জাতীয় বাক্য পরেও কপচানো যাবে, পরে কপচালে
শোক বাসি হয়ে যাবে না। সংবাদমাধ্যমগুলো 'সবার আগে সর্বশেষ সংবাদ' প্রকাশে
প্রতিযোগিতা করলেও 'সবার আগে সর্বপ্রথম শোক' প্রকাশে প্রতিযোগিতা করা যাবে
না।
৪.
ডিপজল আর নেই/ Pori Moni নেই/ চলেই গেলেন তুহিন— এ ধরনের
শিরোনাম দেখে মনে করবেন না ডিপজল, পরী বা তুহিন মারা গেছেন। ক্লিক করলে
ভেতরে দেখা যাবে চিকিৎসাশেষে ডিপজল আর সিঙ্গাপুরে নেই, চলে এসেছেন
বাংলাদেশে; এবারের ইদের কোনো ছবিতে পরী নেই অথবা শুটিং শেষে পরী আর
হোতাপাড়ায় নেই, চলে এসেছেন ঢাকায় এবং তুহিন শিরোনামহীন ব্যান্ড ছেড়ে চলে
গেছেন। নিউজের ভিউ বাড়াতে কিছু বেওয়ারিশ বদমাশ এ ধরনের শ্বাসরুদ্ধকর
শিরোনাম ব্যবহার করে থাকে। এসব লিংক আদৌ ক্লিক না করাই ভালো।
৫.
ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করলেই আপনার আইডি হ্যাক করে ফেলবে, এমন
সাধ্য কারো নেই। আবার, কোনো সত্যিকারের হ্যাকার আপনার আইডি হ্যাক করতে
চাইলে কারও কোনো সাধ্য নেই আপনার আইডিটাকে বাঁচানোর। 'বিশ্বজিৎ দাস একজন
হ্যাকার, এই লোকটি থেকে সাবধান থাকুন; এর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট
করবেন না, করলেই আপনার আইডি হ্যাকড হয়ে যাবে; এই মেসেজটি কপি করে অন্যকেও
সতর্ক করুন'— এ ধরনের মেসেজ গণহারে ফরওয়ার্ড করার অর্থ হচ্ছে 'আমি নিজে বলদ
হয়েছি, এবার অন্যকেও বলদ বানান।'
৬.
ফেসবুক জাকারবার্গের জন্য
আলাদিনের চেরাগ। তিনি ফেসবুক বন্ধ করে দেবেন, এমন সম্ভাবনা অন্তত এখন অবধি
নেই। অতএব 'অমুক তারিখের মধ্যে ফেসবুক বন্ধ হয়ে যাবে' কিংবা 'এই মেসেজটি
বিশ জনকে না পাঠালে ফেসবুক টিম আপনার আইডি ডিজঅ্যাবল করে দেবে' মর্মে ভুয়া
মেসেজ পাঠিয়ে অন্যকে বিরক্ত করা থেকে বিরত থাকুন।
৭.
ইদ-পূজা-নববর্ষে একই টেক্সট, একই অডিও-ভিডিও-কার্টুন কিংবা শুভ সকাল, শুভ
রাত্রি-খচিত ফুল-ফলের একই ছবি গণহারে সবাইকে পাঠাবেন না। উৎসবের কিংবা
সকাল-বিকালের শুভেচ্ছা কেবল গুটিকয়েক ঘনিষ্ঠজনকেই পাঠান। একই জিনিশ সবাইকে
না পাঠিয়ে বরং প্রত্যেকের জন্য আলাদা করে কিছু-একটা লিখুন।
৮.
ঙ
ধর্মের কেউ ঞ ধর্মের অবতার বা পয়গম্বরকে কটাক্ষ করেছে, ধর্মগ্রন্থের ওপর
পা রেখে ছবি তুলেছে, উপাসনালয়ের ছবির ওপর জীবজন্তুর ছবি বসিয়েছে— ফেসবুকে
ইত্যাদি দেখেই শেয়ার করে বসবেন না। মনে রাখবেন আপনার এ ধরনের একটি শেয়ার
গোটা ঙ সম্প্রদায়ের ওপর নামিয়ে আনতে পারে নারকীয় তাণ্ডব। ধর্মাবমাননার এ
জাতীয় ঘটনার প্রত্যেকটিতেই দেখা গেছে আসলে ঞ ধর্মেরই কেউ একজন গোপনে এ
ধরনের ছবি ফটোশপ করে ফেসবুকে ছড়িয়ে দিয়েছে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ
করার জন্য অথবা সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা বাধিয়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ফায়দা
লোটার জন্য।
৯.
গাছে-মাছে, আকাশে-পাথরে, ঘোড়ার চামড়ায়, গরুর
গুর্দায়, ভেড়ার কলিজায় অলৌকিকভাবে কোনো ধর্মীয় শব্দ দেখা গেছে এমন ছবি;
কোনো ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বা পদছাপের ছবি, তার পুরোনো
বাসস্থান বা ব্যবহার্য জিনিশপত্রের ছবি শেয়ার না করাই শ্রেয়। শেয়ার করা
যাবে না ছয়মাথা সাপের কিংবা পাঁচপায়ের গরুর ছবিও। এ ধরনের প্রায় শতভাগ ছবিই
ভুয়া বা ফটোশপকৃত। মায়ের এক ফোঁটা দুধ খেয়ে থাকলে শেয়ার না করে যাবেন না/
মুসলমানের বাচ্চা হলে শেয়ার করুন/ প্রকৃত হিন্দু হলে শেয়ার করে
মুসলমানদেরকে দেখিয়ে দিন/ গরিবের ছেলে তাই বলে কি লাইক পাব না— এ ধরনের
পোস্টে লাইক দেওয়া ও শেয়ার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। ধর্মীয় ও পারিবারিক
আবেগ ব্যবহার করে, চটকদার ছবি দিয়ে বিভিন্ন পেজ বা আইডি প্রথম দিকে এ ধরনের
পোস্ট দিয়ে লাইকার ও ফলোয়ার বৃদ্ধি করে। পরবর্তীকালে নাম পালটে বাণিজ্যিক
কাজে এবং ধর্মীয় উসকানি ও রাজনৈতিক সহিংসতা ছড়াতে এসব আইডি ও পেজগুলোকে
ব্যবহার করা হয়। মনে রাখবেন— আপনি এ ধরনের পোস্ট শেয়ার করছেন মানে
ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সহিংসতার বিষবৃক্ষের গোড়ায় আপনি পানি ঢালছেন কিংবা আপনি
কোনো ধান্দাবাজ অ্যাডমিনের ব্যবসার বকরি হিশেবে ব্যবহৃত হচ্ছেন।
১০.
রক্ত চেয়ে পোস্ট দিলে তারিখ উল্লেখ করুন এবং রক্ত পেয়ে গেলে পোস্ট ডিলিট
করে রক্ত পাওয়ার কথা জানিয়ে আরেকটি পোস্ট দিন। নইলে রক্তসংক্রান্ত একই
পোস্ট ফেসবুকে বছরের পর বছর ধরে ঘুরতে থাকে। দেখা যায় রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি
গেছেন অথবা মারা গেছেন, অথচ তার সুস্থ হওয়ার বা মারা যাওয়ার কয়েক বছর পরও
রক্ত-চাওয়া সেই পোস্ট ঘুরে বেড়াচ্ছে টাইমলাইন থেকে টাইমলাইনে। কারো
রক্তপোস্ট শেয়ার করার আগে ঐ পোস্টের মন্তব্যগুলো ভালোভাবে খতিয়ে দেখুন রক্ত
ইতোমধ্যেই যোগাড় হয়ে গেছে কি না এবং পোস্টটা কত দিনের পুরোনো।
১১.
বন্যার্ত, শীতার্ত, তৃষ্ণার্ত, ক্ষুধার্ত, ইফতার, টোকাই, রোহিঙ্গা, কিডনি,
পিত্তথলি, টিউমার, ক্যানসার, দরিদ্র মেধাবী, দুঃস্থ মুক্তিযোদ্ধা ইত্যাদি
খাতে সাহায্য চেয়ে কেউ পোস্ট দিলেই বা ইভেন্ট খুললেই ঝাঁপিয়ে পড়ে টাকা
পাঠাতে যাবেন না। পোস্টদাতা কোথায় বসবাস করেন, কোথায় পড়ালেখা করেছেন, কার
কার সাথে আড্ডা দেন, কোন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, সেই প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়
কোথায়, পোস্টদাতার সামাজিক ও ভার্চুয়াল গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু— টাকা পাঠানোর
আগে এসব জানতে হবে। বিকাশ নাম্বারটি কার, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট কার নামে খোলা;
জানতে হবে এসবও। জনসেবার কথা বলে, দরিদ্রদেরকে সাহায্যের কথা বলে নারীদের
জন্য জাস্টিসের কথা বলে (এবং এমনকি নিজ মায়ের মিথ্যে অসুখের নাটক সাজিয়ে)
ফেসবুক থেকে টাকা তুলে তা ভিকটিমদেরকে না দিয়ে পুরো টাকা বা লোক দেখানোর
জন্য কিছু টাকা দিয়ে বাকি টাকা লোপাট করে এই ফেসবুকেরই কত ফকির রাতারাতি
কোটিপতি হয়েছে, গাড়ি কিনেছে, ফ্ল্যাট কিনেছে, দামি মাদক নিচ্ছে; এর ইয়ত্তা
নেই। এদের মধ্যে দু-একজন ধরা পড়ে জেলের ঘানি টানছে, কেউ-কেউ ফেসবুকের
গণআদালতে গণবিচারের সম্মুখীন হয়ে আইডি ডিঅ্যাক্টিভেট করে গা ঢাকা দিয়েছে,
কেউ-কেউ বহাল তবিয়তে 'মুক্তিযুদ্ধের গল্প' শোনাচ্ছে।
১২.
রোহিঙ্গা-নির্যাতনের চিত্র বলে যেসব ছবি ও ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল, এর ৯৯
শতাংশ আদৌ মিয়ানমারেরই ছবি না। চীনে ভূমিকম্পে নিহতদের ছবি, তিব্বতে
প্রতিবাদকারীদের নিজ গায়ে আগুন লাগানোর ছবি, থাইল্যান্ডে জলদস্যুদেরকে রোদে
সারিবদ্ধভাবে চিৎ করে রেখে শাস্তিপ্রদানের ছবি, ইন্দোনেশিয়ায় ধর্ষককে
পিটিয়ে মারার ছবি, একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা প্রশিক্ষণের
ছবি, নেপালে নির্মিত চলচ্চিত্রে মৃত মায়ের দুগ্ধপানরত শিশুর ছবি ইত্যাদিকে
রোহিঙ্গাদের ছবি বলে ফেসবুকে বিভিন্ন পেজ থেকে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং
এমনকি পাশাপাশি কয়েকটি ডেকচিতে রান্নারত অজ্ঞাতপরিচয় একটি ছবিতে 'এই দেখুন
কীভাবে বার্মিজ বৌদ্ধরা রোহিঙ্গাদের মাংস রান্না করছে' ক্যাপশন দিয়ে
ফেসবুকে প্রচার করা হয়েছে! আর জেহাদি গরল উগড়ে দিতে সরল বিশ্বাসে এসব ছবি
শেয়ার করে-করে ভাইরাল করছে সাধারণ মানুষ। রোহিঙ্গাদের ওপর যে নির্যাতন
চলছে, তা পৃথিবীর সামনে তুলে ধরতে নির্যাতনের আসল ছবিই যথেষ্ট। ভুয়া ছবি
প্রচার করলে তা গোটা গণহত্যার ভয়াবহতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। অতএব,
নৃশংসতার কোনো ছবি বা ভিডিওতে রোহিঙ্গাসংক্রান্ত ক্যাপশন থাকলেই তা শেয়ার
করা যাবে না, শেয়ার করতে হবে যাচাই করে।
১৩.
কোনো বছরের
সম্ভাব্য নোবেল পদকবিজয়ী কে কে এবং এমনকি বিজয়ী নির্বাচনে বিচারকের ভূমিকা
পালন করেছেন, পদক ঘোষণার পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে নোবেল কমিটি তা
কোনোভাবেই প্রকাশ করে না। তাই, কেউ সম্ভাব্য নোবেলবিজয়ীদের শর্ট লিস্ট
প্রকাশ করলে, নোবেল কমিটি অমুককে টেলিফোনের পাশে থাকতে বলেছে মর্মে খবর
ছড়ালে নগদে তা ভুয়া বলে ধরে নিতে হবে এবং এসব শর্ট লিস্ট শেয়ার করা যাবে
না।
ফেসবুকের শক্তি সম্পর্কে নিশ্চয়ই কারো কোনো সন্দেহ নেই। সামাজিক
যোগাযোগের শক্তিশালীতম মাধ্যম জাকারবার্গের এই ফেসবুক। সত্যাসত্য যাচাই না
করে ফেসবুকে কোথাও লাইক দেওয়া যাবে, কিছু শেয়ার করা যাবে না। মনে রাখতে
হবে— ভুয়া খবরের একটি শেয়ার গোটা একটা সম্প্রদায়কে বিপন্ন করতে পারে,
অস্থিতিশীল করে ফেলতে পারে পুরো একটি রাষ্ট্রকে। কে কই লাইক দিলেন, কে কী
শেয়ার করলেন; এর ওপর নির্ভর করে একজন ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব এবং
ক্ষেত্রবিশেষে একটি রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতাও। যেখানেই বসে, সেখানেই মলত্যাগ
করে মাছি; যত্রতত্র লাইক বা যা-তা শেয়ার মাছিসুলভ স্বভাব, মনুষ্যসুলভ না।
No comments:
Post a Comment