Monday, 16 September 2019

একটা ডেথ সার্টিফিকেট

হঠাৎ দরজায় ঠকঠক শব্দ। দরজা খুলতেই দেখি ত্রিশ পয়ত্রিশ বছরের এক যুবক হাঁপাতে হাঁপাতে বলছে, ভাই আপনার আম্মুর কাছে এসেছি। তার মুখে ভাবলেশহীন চাহনি, টিনের চালে পানি জমে গেলে বৃষ্টি থেমে যাবার পরেও যেভাবে থেমে থেমে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে অনেকটা সেভাবে কপাল থেকে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে জমে কিছুটা বিরতি নিয়ে টপ করে ফ্লোরের উপর পড়ছে।
সে এসেছে একটা ডেথ সার্টিফিকেট জন্য। ঘণ্টা তিনেক আগে তার বাবা মারা গেছে। কথাটা শোনার পর আমার চোখে একটা দৃশ্য ভেসে উঠল, সেটা হল আম্মু যখন আসছিল তখন সে একটা চাপা হাসি দিয়ে বসা থেকে উঠে দাড়িয়েছিল। তার এই সৌজন্যমূলক আচরণ এবং ঘণ্টা তিনেক আগে বাবা মরে যাবার শেষ বাক্য, এ দুটোকে আমি একসাথে করে কোনভাবেই মেলাতে পারছিলাম না। বাস্তবতা এতই কঠিন যে, কখনো কখনো আপনাকে বাবা মারা যাবার একশো আশি মিনিটের মাথায় আসমান জমিন এক করা শোকের চিৎকার থামিয়ে মানুষের বাড়ি গিয়ে বিরতি দিয়ে তিনবার দরজায় কড়া নেড়ে সোফায় বসে অপেক্ষা করে মেপে মেপে সৌজন্যমূলক আচরণ করতে হবে।
আমি ভেবেছিলাম বাইরে থেকে দেখে তাকে শক্ত মনে হলেও ভেতরে ভেতরে নিশ্চয়ই সে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম তার ব্রেইন অত্যন্ত সচল। ডেথ সার্টিফিকেটে গ্রামের নাম, ডাক ঘরের নাম লিখতে হয়। জিজ্ঞাসা করা মাত্রই নিখুঁতভাবে জবাব দিয়ে যাচ্ছে। কখনো কখনো নিজ থেকে কিছু সাজেশনও দিচ্ছে, এই যেমন বর্তমান ঠিকানায় বাড়ি ওয়ালার নাম সংযোজন করতে বলল যাতে করে সহজেই ইনভেস্টিগেশন করা যায়।
জানাজা থেকে কবর দেবার খরচাপাতির বিষয় নিয়ে দুবার তাকে ফোনে কথা বলতে দেখলাম। খরচাপাতি যোগাড় করার বাক্যলাপ,বাড়ি ওয়ালার নাম সংযোজন অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত হওয়া স্বত্বেও কোথায় যেন আমাকে বেশ পীড়া দিল। আমি বরং এভাবে চিন্তা করি যে, জীবনের এত গুলো বছর কাটানো দিন গুলোর কথা ভেবে প্রবল শোকে সে হামাগুড়ি দেবে। দু হাত দিয়ে বুক ধাপড়াতে ধাপড়েতে চিৎকার করে বলবে ' আমার বাপ আসলে মরেনি' !!
প্রচণ্ড মায়া এবং কৌতূহলের কারণে আমি তাকে খুব মন দিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম। তার চুপ করে বসে থাকা, তার কথা বলা, কথার ব্যাখ্যা কিংবা অন্যসব কিছুর চাইতে আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে তার চোখ দুটো। যেন আমি ভলিউম মিউট করে কোন একটা মুভি দেখছি। শব্দহীন সেই আলোকচিত্রে অদ্ভুদ এক রহস্য উদঘাটন করলাম।
সে কথা বলতে বলতে হঠাৎ করেই ন্যানো সেকেন্ডের জন্য কোথায় যেন হারিয়ে যায়। চোখ দুটা কেমন ঝাপসা হয়ে ওঠে। একটা আঙুল মুখের কাছে এনে দুটা চোখের মনি এক করে তাকালে যেরকম দুটা আঙুল দেখা যায়; আচংকা কথা বলতে বলতেই চোখের সেই অন্যমনস্ক রূপটা বের হয়ে আসে।
কথা বলতে বলতে হঠাৎ করেই কথার খেই হারিয়ে ফেলে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে যেন হঠাৎ জ্ঞান ফিরে পেয়েছে এমন একটা ভাব করে তার সামনের মানুষটাকে জিজ্ঞাসা করে - '' কী যেন বলছিলাম ? ''
বাস্তবতা এতই নির্মম যে সে কখনো কখনো আপনাকে ঠিকভাবে কান্না করার সুযোগও দেবে না। এই যে চারপাশে এত এত মানুষ আপন মানুষদের হারিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, বাইরে থেকে দেখে মনে হবে মানুষটা হয়ত এই শোক কাটিয়ে উঠেছে। এই তো সব কাজ নিজেই করছে। শুধু সেই জানে রাস্তা পার হতে গিয়ে, জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালতে গিয়ে কিংবা কথা প্রসঙ্গে হাসতে হাসতেই হঠাৎ করেই ন্যানো সেকেন্ডের জন্য কোথায় যেন হারিয়ে যায় সে। এক একটা মানুষ যেন রক্ষণাবেক্ষণহীন প্রাচীন দেয়ালের মত; বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই সামান্য ধাক্কা দিলেই সেটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে।
 

No comments:

Post a Comment

অভিশপ্ত রজনী

  মৃত মেয়েটিকে ধর্ষণ করার সময় মেয়েটি যে জীবিত হয়ে ওঠে সেটা খেয়াল করেনি নেশাগ্রস্ত অবস্থায় কাব্য।ধবধবে সাদা চামড়ার মেয়েটিকে ভোগ করার...