Tuesday, 21 July 2020

ডিমলা ভ্রমণ

সময়টা জুন ২০১১। টানা নয়দিন বৃষ্টি। এর মাঝেই ফিল্ড ওয়ার্কে যেতে হলো উত্তরের সীমান্তবর্তি জেলা নীলফামারীর ডিমলা উপজেলায়। নীলফামারী জেলাকে নীলের দেশ বলা হয়। এই জেলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ভু-সংস্থান বেশ সমৃদ্ধ যা অন্যান্য জেলা থেকে এই জেলাকে কিছুটা হলেও আলাদা করেছে। জেলার উত্তরদিক কিছুটা উচু এবং খরা পিরিত অঞ্চল, পূর্ব দিক তিস্তার বালুকাময় এলাকা, এই উচু ও বালুময় ভুমি ধীরে ধীরে দক্ষিনপশ্চিম দিকে উর্বর কৃষি জমিতে পরিনত হয়েছে। এই জেলা অতীত ইতিহাসের অনেক সাক্ষী বহন করে। এখানে সত্য পীরের গান, হাঁস খেলা, মাছ খেলা সহ অনেক উৎসবের আয়োজন হয়।
তিন জনের টিম, তিনদিনে এলাকা কভার করে আসতে হবে। ডিমলা উপজেলা ডাকবাংলোতে আগে থেকেই থাকার ব্যবস্থা করা ছিলো। তিনজন তিনদিকে না গেলে কাজ শেষ হবে না, তাই ওখানে গিয়ে এলাকা ভাগ করে নেয়া হলো। আমার ভাগে পড়েছিলো একাবারে উত্তরের এলাকা, সবগুলো এলাকার নাম মনে না থাকলেও কিছু কিছু এলাকার নাম মনে আছে এখনো। ছাতনাই, শোভনগঞ্জ বালাপাড়া, বালাপাড়া, উত্তর ছাতনাই বালাপাড়া, উত্তর সুন্দরখাতা, নিজ সুন্দরখাতা, মধ্যম সুন্দরখাতা উল্লেখযোগ্য। এলাকার মানগুলো যেমন সুন্দর, মানুষগুলোর মন তার চেয়ে অনেক বেশী সুন্দর।
সত্যি কথা বলতে প্রথমদিন সেখানে পৌঁছে বিশ্রামের পরে কাজে বেরুবার ইচ্ছে থাকলেও বৃষ্টির কারণে বের হতে পারিনি। সন্ধ্যায় উপজেলা বাজারে ঘুরেই সময় কাটিয়ে দিয়েছি। হাতে থাকে দুই দিন। তিনদিনের কাজ দুই দিনে শেষ করতে হবে। মানে কাজের চাপ বেড়ে গেলো দেড় গুন। পরদিন সকালে বৃষ্টির মধ্যেই রেইনকোট গায়ে পেচিয়ে, ছাতা মাথায় বেরিয়ে পড়লাম ছাতনাই, শোভনগঞ্জ বালাপাড়া, বালাপাড়া, উত্তর ছাতনাই বালাপাড়ার উদ্দেশ্যে। ভেবেছিলাম প্রথমদিনে এই এলাকায় কাজ শেষ করবো। প্রত্যন্ত গ্রাম বলে সেই এলাকায় পৌছুতে আমার দুপুর হয়ে গেলো। খাবার জন্য কোন হোটেল/রেষ্টুরেন্ট না থাকায় দোকান থেকে কলা আর রুটিতেই সারতে হলো দুপুরের খাবার। খেয়ে যথারীতি কাজ শুরু। কাজের চাপ এত বেশী ছিলো যে, কখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে বুঝতেই পারি নি। ছাতনাইয়ের কাজ শেষ করে তখন পর্যন্ত আমি শোভনগঞ্জ বালা পাড়ায়। ওখানে একটা স্থানীয় মসজিদে মাগরিব নামাজ পড়ে মনে মনে স্থীর করলাম আজ আর নয়, ফিরে যাই ডাক বাংলোয়। মাটির রাস্তা হওয়ায় প্রচন্ড পিচ্ছিল আর কাদাযুক্ত ছিলো পথটি। কিছুদুর এগিয়ে অন্ধকারের মাঝে পিটপিট করে আলো জ্বলতে দেখলাম। রাস্তার পাশের একটি ছোট টং দোকান। পুরো দোকানের সমস্ত মালামালের দাম হবে হয়তো পাঁচশো টাকার মত। ভিতরে শুকনা একজন দোকানী। সেখানে বসে চা খাওয়ার ইচ্ছে পোষন করায় আমাকে কেতলীর ঠান্ডাপ্রায় লিকারের চা খেতে হলো। কথা হচ্ছিল দোকানীর সাথে, নাম লোকমান। তাকে জিজ্ঞাস করলাম এখান থেকে ডিমলা পৌছুনোর ব্যবস্থা কী? আমাকে জানালো এখান থেকে দেড় কিলো গিয়ে পাকা রাস্তা পাবো, সেখান থেকে ডিমলা যাবার ব্যবস্থা হতে পারে। শরীর এত ক্লান্ত যে, সেখান থেকে উঠে অন্ধকার, অপরিচিত ও কর্দমাক্ত পথে দেড় কিলো হাটার শক্তিটুকু হারিয়েছিলাম। কষ্ট পাচ্ছিলাম এই ভেবে যে, পরদিন সকালে আবার আসতে হবে এই এলাকায়।
বাকী কলিগদের সাথে যখন ফোনে কথা বলছিলাম তখন কথায় কথায় বলেছিলাম “এই এলাকায় একটা মসজিদ পেলে থেকে যেতাম সেখানে, আজকে ফেরার এনার্জি নাই”। লোকমান আমার কথাগুলো মন দিয়ে শুনছিলো। কথা শেষে লোকমান নিজ থেকেই আমাকে অফার করলো তার বাড়িতে আজ থেকে পরদিন কাজ সেরে একবারে যেতে। ঢাকার মত এক যান্ত্রিক শহরে বসবাস করি বলে আমি নিজেও মানবিক গুনাবলী হারাতে বসেছিলাম। পরিচিত কেউ এলাকা থেকে আসলে এক দিনের বেশি দুদিন হলেই মনে মনে ভাবতাম কখন যাবে? আর অপরিচিত কাউকে বাসায় আসার কথা বলা তো ভাবাই যায় না। এদিকে রাত আটটা পেরিয়ে গেছে, আমি আর লোকমান ছাড়া কেউ বাহিরে আছে বলে মনে হয় না। এরই মাঝে শুরু হলো তুমুল বৃষ্টি। প্রায় পৌনে নয়টা নাগাদ বৃষ্টি ছাড়লেই লোকমান আমাকে ডিমলা না গিয়ে তার বাড়িতে রাত্রি যাপনের জন্য তাড়া দিতে লাগলো। এক পর্যায়ে আমি তার বাড়িতে যেতে রাজি হই। দোকান থেকে বের হয়ে পাঁচ মিনিটের পথ। বাড়ি বলতে ছোট্ট একটা ঘর। ছনের ছাউনি আর পাটখড়ির বেড়া। অবশ্য ঘরের ভিতরে তিনফুট উচ্চতায় একটা পার্টিশন দিয়ে একপাশে রান্নাঘর বানানো হয়েছে। মেহমান বাড়িতে দেখা লোকমানের বউ কোন প্রকার মন খারাপ তো করেই নি, বরং উৎসাহ নিয়ে রান্নার কাজে চলে গেলো। আমি ঘরে ঢুকে মাচার (বাঁশ দিয়ে তৈরী যা খাটের বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করা হয়) উপরে বসলাম। একদিকে রান্নার কাজ চলছে, অন্য দিকে রাতে শোবার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ওহ... বলতে ভুলেই গেছি, লোকমানের একটি মেয়েও আছে তিন বছরের (নামটা মনে করতে পারছি না)। খুব কথা বলে মেয়েটি। আমার সাথে আপন হতে তার সময় লেগেছে দুই মিনিট। রান্না শেষে মাচাতেই খাবারের ব্যবস্থা হলো। একটা ডিম রান্না করে দুইভাগ করে দুজনকে দেয়া হয়েছে আর লোকমানের স্ত্রী মেয়েকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাদেরকেও একসাথে খেতে বসতে বললাম। গ্রামের মেয়ে বলে হয়তো বসতে চাচ্ছিলো না। পরে অনেক জোড়াজুড়িতে আমাদের সাথে বসেছে। তিনটি প্লেট আর একটা বাটিতে চারজন খাওয়া শুরু। ডিমের টুকরো দুটোকে চার টুকরো করে চারজনে খাবার শেষ করলাম। রাতে ঘুমানোর জন্য রান্না ঘরে ধানের খড় বিছিয়ে তার উপরে পাটি এবং তার উপরে কাথা বিছিয়ে শান্তির একটা ঘুম দিয়ে পরদিন সেখান থেকে বিদায় নিয়ে সারাদিন কাজ সেরে সন্ধ্যায় ডাকবাংলোতে ফিরলাম।
শুধু মনের মধ্যে আটকে থাকলো লোকমানের পরিবারের মানুষগুলোর সরলতা আর আথিথেয়তা।
একটা ডিম চার টুকরো করে খাওয়ার মাঝে যে আনন্দ, সেটা আসলেই ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।

No comments:

Post a Comment

অভিশপ্ত রজনী

  মৃত মেয়েটিকে ধর্ষণ করার সময় মেয়েটি যে জীবিত হয়ে ওঠে সেটা খেয়াল করেনি নেশাগ্রস্ত অবস্থায় কাব্য।ধবধবে সাদা চামড়ার মেয়েটিকে ভোগ করার...