কোভিড ১৯ পজেটিভ অবস্থায় আইসোলেশনে থাকা কালীন সময়েই অনেক স্বজন-বন্ধু অনুরোধ করেছিলেন আমার এই অভিজ্ঞতা যেনো আমি সবার সাথে শেয়ার করি। আমারও মনে হয়েছিল, হ্যা এতে যদি কেউ সামান্যও উপকৃত হন তাহলে আমার লেখাই উচিৎ হবে। কিন্তু বাসার পরিস্থিতি বেশ জটিল হয়ে যাওয়ায় ইচ্ছে থাকলেও সেটা আর হয়ে উঠেনি। তার উপর ভেবেছি অনেকেই তো লিখছে, সেখান থেকেও তো মানুষ জানতে পারবে। পাশাপাশি কিছুটা ভয়ও কাজ করছিলো - শুধুমাত্র নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে জাজমেন্টাল হওয়া উচিত হবে কীনা? একইসাথে চিকিৎসা শাস্ত্র নিয়ে কথা বলে মানুষকে ঝুঁকিতে ফেলে দেয়ার একটা আশংকাতো আছেই।
কিন্তু পজিটিভ রিপোর্ট পাবার পর থেকে গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৪০/৫০ টিরও বেশি ফোন কল পাই পরামর্শ চেয়ে। এতো অসহায়ত্ব থাকে তাদের কণ্ঠে। যেটুকু পারি সহযোগিতা করি।
আজ মনে হচ্ছে, অভিজ্ঞতাটা শেয়ার করা আসলে খুবই প্রয়োজন। সাধারণ মানুষ আজ খুবই বিপন্ন। না পারছে টেস্ট করতে না পারছে চিকিৎসকের কাছে যেতে আর হাসপাতাল তো তাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। মফস্বল শহরের অবস্থা আরো করুণ।
সারাদেশে আজ প্রচুর মানুষ করোনার সিমটমে ভুগছে। টেস্ট না করাতে পেরে অনেকেই দিশেহারা। বাসায় বসেই বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া জ্ঞান নিয়ে নিজেদের চিকিৎসা নিজেরাই করছে। কিন্তু অনেকের কাছে তো এই তথ্যও নেই।
তারিখটা ১০ মে ২০২০। হঠাৎ করেই সাথীর শরীরে জ্বর, মাত্রা ১০১। নরমালই ঔষধ খাওয়া শুরু। পরদিন সকাল থেকে আমার শরীরে একটু একটু জ্বরের ভাব বুঝতে পারছিলাম। বেলা ১১টা নাগাদ জ্বর ১০২.৭। সাথে কাশি আর শরীর ব্যথা। ১৬ তারিখে টেষ্টের জন্য ট্রাই করা শুরু করে ১৮ তারিখে নমুনা দিতে সক্ষম হলাম। জানালো ৫ দিন সময় লাগবে। একে একে পাঁচদিন, ছয়দিন, সাতদিন পেরুলেও রিপোর্ট পাবার কোন লক্ষন না দেখে বাধ্য হয়েই Institute of Epidemiology, Disease Control and Research (IEDCR) রোগতত্ত্ব , রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে যোগাযোগ করি। অনেক খুঁজাখুঁজির পরেও রিপোর্ট সংগ্রহ করতে পারলাম না। এর মধ্যে সকলের জ্বর কিছুটা কমলেও কাশী রয়েই গেছে। ৩১ মে ল্যাব এইড থেকে প্রথম টেষ্ট করাই। তৃতীয় দিন অর্থাৎ ০২ জুলাই দুপুরে সাথীর করোনা পজেটিভের রিপোর্ট পেলাম। টেস্ট করতে দেয়ার ৪/৫ দিন আগ থেকেই (ঈদের দিন থেকে)বলছিল- তোমরা আমার কাছে এসো না, শরীরটা ভালো লাগছে না, জ্বর জ্বর লাগছে। আমি ব্যাপারটা অতো সিরিয়াসলি নেইনি। কারণ তার মাঝে মাঝেই জ্বর জ্বর লাগে, কিন্তু জ্বর আর আসে না। এদিকে সে ডাক্তারের পরামর্শে ওষুধ খাওয়া শুরু করেছে, সাথে শুরু হয়েছে গরম পানি আর মশালা চা খাওয়া। স্যালাইন আর লেবু খাওয়া। আর গরম পানির ভাপ নেয়া।
অবশেষে ০২ জুন দুপুরে ভ্যা ভ্যা করে কান্না করতে করতে আমাকে ফোনে জানালো রিপোর্ট পজেটিভ।
এ পর্যায়ে যা করতে হবে
১. যেকোনো সিমটম দেখা দেয়া মাত্রই আপনাকে সতর্ক হতে হবে।
২. সম্ভব হলে নিজেকে কোয়ারেন্টাইনে নিতে হবে অথবা পরিবারের অন্য সদস্যদের থেকে দূরে থাকতে হবে।
৩. মাস্ক পড়তে হবে সবসময়, পরিবারের সবাইকে।
৪. অবশ্যই টেস্টের জন্য চেষ্টা করতে হবে।
৫. ডাক্তারের পরামর্শে ওষুধ খেতে হবে।
৬, গরম পানি খেতে হবে, দিনে ৩/৪ বার মাসালা চা খেতে হবে, গরম পানির ভাপ নিবেন, প্রচুর ভিটামিন সি ও জিংক সমৃদ্ধ খাবার খাবেন, মেন্যুতে অবশ্যই প্রচুর প্রোটিন রাখবেন, দিনে কমপক্ষে ২ টা করে ডিম অবশ্যই খাবেন (পরিবারের সবাই মিলে)
৭. অবশ্যই সবাইকে হ্যান্ড স্যানিটাইজ করতে হবে বারবার আর আর বাসাকেও জীবানুমুক্ত রাখার চেষ্টা করতে হবে।
মনে মনে আশাবাদী হলেও প্রস্তুত ছিলাম এরকম একটি খবর শোনার জন্য। ভেবে নেয়াই ছিল যা পরিস্থিতি তাতে যে কোনো সময়ে আমরা আক্রান্ত হতে পারি। মন খারাপ হলেও আতংকিত হলাম না। এতদিনের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বুঝতে পেরেছিলাম এ রোগ থেকে সুস্থ হবার হার অনেক বেশি, মৃত্যু হার থেকে।
রিপোর্ট পাবার পর নিজেদেরও কিছু ভাবনা চিন্তা করার ব্যাপার ছিলো। বিষয়টা সবাইকে জানাবো কিনা, জানালে রিএকশনটা কেমন হতে পারে। নিজ বাড়ি এবং শ্বশুরালয়ের মানুষগুলো খবরটা শুনলে নিজেদের সামাল দিতে পারবে কিনা এটা ছিল বড় একটা চিন্তার বিষয়।
আরেকটা ভাবনার বিষয় ছিলো হোম ম্যানেজমেন্ট। আমরাও যেহেতু বাইরে যেতে পারবো না আর বাইরে থেকেও কেউ আসতে পারবে না তাহলে আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় বাইরের কাজগুলো কিভাবে সারবো?
এদিকে আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় জানিয়ে দিলাম সবাইকে। কারণ আমাদের মনে হয়েছিল এটা লুকিয়ে রাখার মতো কোনো বিষয় নয়। বিষয়টি জানা থাকলে সবাই সতর্ক থাকবে। আর আমাদেরও এ অবস্থায় সবার সহযোগিতার প্রয়োজন আছে।
এরপর থেকে আসা শুরু হলো ফোন। দুজনের ফোনেরই কোনো রেস্ট ছিলো না।
নিজেও অল্প অল্প কাশি হচ্ছিল, মাঝখানে ২ রাত কাঁপুনি উঠেছিল, আর ১ দিন জ্বর।
মনে মনে জেনেই গিয়েছিলাম আমার পজেটিভ আসবে। মেয়েটাকে নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। বেশ সচেতনভাবেই মায়ের অসুখের শুরু থেকে আমার আর মায়ের কাছ থেকে দূরে দুরেই ছিল। কিন্ত রাতে একা ঘুমাতে ভয় পায় বিধায় ওর মায়ের রুমেই নীচে বিছানা করে দিতে হয়।
১৪ জুন আবার টেষ্ট করালাম, ১৫ তারিখ রাতে রিপোর্ট হাতে পেলাম। এবার বাসার তিন সদস্যই পজিটিভ।
এই পরিস্থিতিতে আক্রান্ত ব্যক্তির পরিবারের যা করণীয় :
১. আতংকিত হবেন না
২. ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন
৩. প্রতিবেশীদের জানান যাতে তারা সতর্ক থাকতে পারে এবং প্রয়োজনে সহযোগিতা করতে পারে
৪. আত্মীয় বন্ধু স্বজনদের জানান, কারণ সবার সহযোগিতার প্রয়োজন আছে। অন্ততঃ তারা আপনাকে নিঃসংগ হতে দিবে না
৫. বাসার পাশের বা এমন ফার্মেসীর/ অক্সিজেন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের ফোন নাম্বার সংগ্রহে রাখুন যারা প্রয়োজনে ওষুধ বাসায় পৌঁছে দিবে।
৬. বয়স্ক কাছের মানুষদের জানানোর ক্ষেত্রে খুব কৌশলী হোন
৭. বর্তমান পরিস্থিতিতে সবারই মানসিক ভাবে তৈরি থাকতে হবে যে আমি/আমরা আক্রান্ত হতে পারি।
৮. পরিবারের বয়স্ক ও ছোটদেরকে খুব সহজ ভাবে আগে থেকেই অসুখটি সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে যাতে তারা ভয় না পেয়ে বাস্তবতা বুঝতে পারে।
৯. প্রতিবেশিদের সহানুভূতিশীল আচরণ ও সহযোগিতা এ অবস্থায় সব থেকে বেশি প্রয়োজন।
১০. নমুনা পরীক্ষা করতে ব্যথা লাগে না, খুব অল্প সময়ের বিষয় এটি। আক্রান্ত ব্যক্তির আত্মীয় স্বজন বন্ধুসহ প্রিয়জনদের কাছে অনুরোধ, যতটা পারুন পরিবারটিকে সহযোগিতা করুন। হয়তো মুখ ফুটে তারা অনেক কিছুই বলবে না, সেক্ষেত্রে আপনিই এগিয়ে আসুন। কখনো তারা যেনো নিজেকে অসহায় মনে না করে।
৩০ জুন, রাত ১১টা ২৯ মিনিট। শুয়ে পড়েছি। কিন্তু ঘুম আসছে না। হঠাৎ বেজে উঠলো মোবাইলের মেসেজ টোন। আগ্রহভরে হাতে নিয়ে চেক করলাম। দেখি, সেন্ডার ব্র্যাক। মেসেজ ওপেন করে দেখি করোনা টেস্টের রেজাল্ট নেগেটিভ। সত্যিই তখন যা মনে হচ্ছিল তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। মনে মনে বললাম, আল্লাহ তুমি সত্যিই মহান। এই যাত্রায় প্রাণটা ফিরিয়ে দিয়েছো। শুকরিয়া। কোভিড-১৯ এর সাথে বাস করতে গিয়ে টানা ৫০ দিন যে ধকলটা গেছে, সেটা মুহূর্তেই ভুলে গেলাম।
No comments:
Post a Comment