Wednesday 25 April 2018

পোড়াকপালি ---------


সারাদিন গ্রামের মাটি থর থর করে মেয়েটির পায়ের নাচনে।মাটিও যেন ছন্দ মিলায়,গলায় গলায়।
ছেলে মেয়ে বাদ বিচার নেই,গোল্লাছুট, মার্বেল, ফুটবল সবটাতেই তার সমান দক্ষতা। কার গাছের নারিকেল পেড়ে দিতে হবে,কার পুকুরের মাছ ধরতে হবে, কার ক্ষেতে আজ হাল ধরতে হবে-একটাই ডাক,'স্মৃতি'।
যখন যেখানে বেলা হয়,পেট ক্ষুধায় পোড়ে-"ও খালা কিছু খাইতে দাও।"
সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরে,কানে আঙ্গুল দিয়ে মামাতো বোন টুনির সাথে সারাদিনের গল্প জুড়ে দেয়।ও দিকে মামীর তিরস্কার এর ঝড় বাড়তেই থাকে। নানীও মাথায় গুতো মেরে বকা দেয়,"পোড়া কপালী, আর কত যন্ত্রনা দিবি?তোর বয়স বাড়লো,শরীর বাড়লো-বুদ্ধি ক্যান বাড়ে না?"
স্মৃতিও নানীর বুকের সরে যাওয়া কাপড় ঠিক করে দিয়ে বলে,"তুমিতো বুড়ি হইলা,এখনো গতরটা ঠিক করে সামলাতে পারোনা ক্যান?ঝগড়াইট্টা বুড়ি।"
মামী যখন মা,বাবা তুলে তিরস্কার করে তখন স্মৃতি গম্ভীর হয়ে যায়, নানীর তখন ভীতরটা খাঁ খাঁ করে।
স্মৃতির জন্মের সময় মা মারা যায়,বাবা স্ত্রীর স্মৃতি বুকে নিয়ে ৩ বছর পার করলেও হঠাৎ মারা যায়। তারপর থেকে শিশু স্মৃতি নানা বাড়িতে,নাম বদলে গেছে-পোড়া কপালী বললেই সবায় সহজে চিনে-মামীর দেয়া নাম।
স্মৃতি কোন কিছুই গায়ে মাখে না-
সকালের সূর্যের আগেই ঘর ছেড়ে বের হয়ে যায়,১৮ বছরের শ্যামলা বর্ণের স্মৃতি, জীবনের একটি মূহুর্তও নিরস যেতে দেয় না। নানা,দাদা,মামা,কাকা,ভাই কোন ভ্রুক্ষেপ নেই তার-কেউ তিরস্কার করলে, সে খিল খিল করে হেসে গ্রাম মাতিয়ে তোলে। পোড়াকপালি বলেই কেউ অন্য দৃষ্টিতে স্মৃতির দিকে তাকায় না হয়তো।
৭১ এর স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হলো-
গ্রামের বাতাসও যেন বদলে গেল,স্মৃতির দম বন্ধ হয়ে আসছে এমন গুমট পরিবেশে।গ্রামে বের হওয়া বন্ধ হয়নি তার কিন্তু এখন হৈ চৈ নয় চারদিকে নিরবতা। কোথাও বাঁশের ঝোপে ভাইদের গোপন বৈঠক,কোথাও নানা দাদাদের হা হুতাশ,কোথাও রেডিওর সামনে জমাট ভীড়। দিনের সাথে সাথে ভয়ঙ্কর রূপ নিলো গ্রামটা,জেলা সদরের গা ঘেঁসে গ্রামটা- পাকিস্তানিরা চলে এলো দলেবলে। ক্যাম্প টা বিশাল,বিভাগ কন্ট্রোল হয় এই ক্যাম্প থেকেই। রাতে চুপি চুপি স্মৃতি ভাইদের বৈঠকে যায়,চিড়া মুড়ি, গুড নিয়ে। আর বসে বসে ওদের আলোচনা শুনে একমনে।ভাগ করে করে গ্রামের ছেলেরা ছড়িয়ে পড়ছে বিচ্ছিন্ন ভাবে এখন রোজ বৈঠক হয় না।গ্রামের মেয়ে,মহিলা প্রায় ঘর বম্দী হয়ে গেছে--
আজ স্মৃতির নানা বাড়িতে হামলা আর্মিদের। স্মৃতি সহ মামী এবং অন্য প্রাপ্ত বয়স্করা লুকিয়ে পড়েছে,স্মৃতির মামা আর্মিদের সাথে কথা বলছে-নানান প্রশ্নের উত্তর।
টুনি গরুর ঘাস পানি দিচ্ছে গোয়াল ঘরে-আর্মিরা এ বাড়িতে কোন যুবক,মুক্তিযোদ্ধা বা যুবতীর হদিস পেল না। কিন্তু এত বড় দলটা খালি হাতে ফেরত যাবে?
গোয়াল ঘরে চোখ পড়লো,তাগড়া গরুটা আর ৯ বছরের টুনি। গরু নিয়ে যায় যাক কিন্তু টুনি---!
শরীর একটু বাড়ন্ত হলেও এখনো বিছানা ভিজায় টুনি। মামার হাউ মাউ ঘরের কোন থেকে দেখছে সবায়। মামী,নানী কাঁদছে মুখে কাপড় চেপে-টুনিকে নিয়ে যাচ্ছে। স্মৃতি বের হয়ে এলো উঠোনে,আর্মিদের বললো-"ঐ বাচ্চাটাকে রেখে যান,আমি যাবো আপনাদের সাথে।"
পরিবেশ থমকে গেল,আর্মি গুলোর চোখে লালসার হাসি। স্মৃতি, টুনিকে মামীর কাছে পৌছে দিয়ে আসলো-নানী স্মৃতির হাত ধরে ফেললো।স্মৃতি আবারও নানীর কাপড় ঠিক করে হাসলো-"আমি তো পোড় কপালী'ই,,টুনির কপালটা আর না পুড়ুক।"নানীর হাতের শক্ত বাধন খুলে স্মৃতি চললো আর্মি ক্যাম্পে।
কিছুদিন পর এক ফাঁকে ছুটে এলো,গ্রামের বড় ভাই এর কাছে। যিনি সম্মুখে থেকে সব তথ্য আদান প্রদান করেন,মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। স্মৃতি বললো,"আগামী পরশু ক্যাম্প এ বিশাল মিটিং, সব বড় কর্তা আসবে।খাবারের হিসাব থেকে বুঝেছি প্রায় ৩০০ আর্মি থাকবে, পরশু সন্ধ্যায়।"
বড়ভাই ও হঠাৎ বুঝে উঠতে পারেনি,স্মৃতির উদ্দেশ্য। স্মৃতিই পরিষ্কার করলো,কি করা যায় ঐ দিন। "সে মোতাবেক সব প্রস্তুতি গ্রহন করুন,পরশু ভোরে আমি আবার আসবো।" বড়ভাই চিন্তিত,"কিন্তু কাজটা করবে কে?" স্মৃতি কালবিলম্ব না করেই সিদ্ধান্ত দিলো-"আমি"
সংক্ষেপে সারমর্ম শেষ করে স্মৃতি ঘোমটা টেনে দ্রুত পায়ে চলে গেল।
একদিন পর ভোরে স্মৃতি আবার এলো,৮/১০ জন মুক্তিযোদ্ধা অপেক্ষা করছিলো তার জন্য।সব বুঝে নিয়ে স্মৃতি চলে গেল ক্যাম্পে-বিকেল হতেই ক্যাম্প মানুষে ভরে যাচ্ছে। বিয়ে বাড়ির মত আয়োজন-আরো কিছু মেয়ে সহ স্মৃতি তাদের মনরঞ্জন। আর্মি অতিথির সাথে স্মৃতি প্রোমেদের পাশাপাশি খোস গল্পও জুড়ে দিলো-"আমি সুন্দর নাচতে পারি।" টোপ গিলে নিলো আর্মির অফিসারটি।
সন্ধ্যায়,বিশাল মাঠে ৩০০ এর উপর অফিসার মিটিং এ বসলো। মিটিং শেষে স্মৃতির নাচ-----
স্মৃতি এর আগে কখনো নাচের মুদ্রা তোলেনি পায়ে। আজই প্রথম-শাড়ির আঁচলে বাধা বেশ কয়েকটি বোমা পর পর ছুড়লো পুরো মিটিং কভার করে। একজনও বাঁচেনি-৩০০ এর বেশি পাকিস্তানি আর্মি আর স্মৃতির নিথর দেহে ক্যাম্প মাঠ ছেয়ে আছে। আশে পাশে ওৎ পেতে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা আসলো,সব দেহ মাড়িয়ে মাড়িয়ে স্মৃতির দেহটা কাঁধে নিয়ে ছুটছে গ্রামে।পুরো এলাকা বোমার আওয়াজে স্তব্ধ হয়েছিলো-
মুক্তিযোদ্ধার দল,স্মৃতির দেহ কাঁধে করে আনছে দেখে গ্রামের বউ বাচ্চারা আনন্দে চিৎকার করে উঠলো-----
পোড়াকপালি ফিরা আইছে রে--------


No comments:

Post a Comment

অভিশপ্ত রজনী

  মৃত মেয়েটিকে ধর্ষণ করার সময় মেয়েটি যে জীবিত হয়ে ওঠে সেটা খেয়াল করেনি নেশাগ্রস্ত অবস্থায় কাব্য।ধবধবে সাদা চামড়ার মেয়েটিকে ভোগ করার...