Wednesday, 25 April 2018

ইদি আমিন : উগান্ডার স্বৈরাচারী কসাই


দ্য বুচার অব উগান্ডা নামে সমধিক পরিচিত ইদি আমিন দাদা আফ্রিকার ইতিহাসে অন্যতম বর্বর ও স্বৈরাচারী একনায়ক। ১৯৭০ এর দশকে উগান্ডায় সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আরোহণ করেন এবং আট বছরের শাসনামলে ১ লক্ষের অধিক মানুষকে হত্যা, গুম, নির্যাতন, নির্বাসন কিংবা ফাঁসি দেন এই উগান্ডান কসাই। তবে এই সংখ্যাটি অনেক হিসেবে ৫ লক্ষও ছাড়িয়েছে! এই স্বৈরাচারী শাসকের মৃত্যু হয়েছিল ২০০৩ সালের আজকের দিনে। চলুন দেখে আসি কীভাবে সাধারণ পরিবারে জন্ম নেওয়া এক সাধারণ বালক হয়ে উঠলো বর্বর খুনী।
জন্ম
১৯২৫ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধিভুক্ত নীল নদের পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশের কোবোকো নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন ইদি আমিন। ১৯৬২ সালে স্বাধীনতা লাভ করে উগান্ডা প্রজাতন্ত্রের অন্তর্গত হয় এই অঞ্চল। এই অঞ্চলে বসবাস করতো কাকওয়া নামক ইসলাম ধর্মাবলম্বী ছোট্ট একটি আদিবাসী গোষ্ঠী। আমিন তেমনই এক আদিবাসী পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন।
কেএআর
শৈশবে বাবা হারানো আমিন বড় হয়েছিলেন তার মায়ের কাছে। দারিদ্র‍্যক্লিষ্ট আমিন প্রাথমিক শিক্ষা কতটুকু লাভ করেছিলেন, সে সম্বন্ধে বিতর্ক আছে। তবে বাল্যকালেই যে সংসারের অভাবমোচনের কাজে নেমে পড়েছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। ১৯৪৬ সালে ২১ বছর বয়সী আমিন যোগ দেন কেএআর তথা কিংস আফ্রিকান রাইফেলস-এ। এই কেএআর হচ্ছে ব্রিটিশদের আফ্রিকান ঔপনিবেশিক সেনাবাহিনী। আমিন এই সেনাবাহিনীতে থাকাকালীন বার্মা, সোমালিয়া, উগান্ডা আর কেনিয়ায় কাজ করেছেন। স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন এবং সশরীরে অংশ নিয়েছেন কেনিয়ার মাউ মাউ বিদ্রোহীদের উপর ব্রিটিশদের বর্বরতায়। মনের মধ্যে স্বৈরাচারের বীজ সম্ভবত তখনই রোপিত হয়েছিল তার।
ইদি আমিন দাদা একজন দক্ষ বক্সার ছিলেন। বেশ কয়েকবার তিনি উগান্ডা লাইট হেভিওয়েট বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছিলেন। তবে যে বিষয়ে তিনি অধিক দক্ষ ছিলেন, সেটি হচ্ছে বর্বরতা। কেএআরে কাজ করার সময় তিনি যতটা না একজন সৈনিক হিসেবে দক্ষতা ও সুনাম অর্জন করেন, তার চেয়ে বেশি কুখ্যাত হন একজন নিষ্ঠুর অফিসার হিসেবে। খুব দ্রুতই তিনি প্রমোশনের সিঁড়ি বেয়ে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হন এবং শেষ পর্যন্ত ইফেন্ডি পদ লাভ করেন। ইফেন্ডি ছিল ব্রিটিশ আর্মিতে আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ সৈন্যদের জন্য সর্বোচ্চ পদ, লেফটেন্যান্টের সমতুল্য।
ওবোতের সাথে বন্ধুত্ব
কেনিয়ার মাউ মাউ বিদ্রোহীদের দমনের সময় ইদি আমিনের বর্বর ভূমিকাই মূলত তার পদোন্নতি ত্বরান্বিত করেছিল। ১৯৫১ সালে যিনি হয়েছিলেন একজন সাধারণ সার্জেন্ট, সেই ইদি আমিন মাত্র দশ বছরের ব্যবধানে ১৯৬১ সালে লেফটেন্যান্ট পদে উন্নীত হন। তবে বহুরূপী ব্রিটিশরা উগান্ডার স্বাধীনতার পর আমিনের এই নিষ্ঠুরতাকেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে উল্লেখ করলো! ১৯৬২ সালে উগান্ডা এবং কানাডার দুটি আদিবাসী গোষ্ঠীর মধ্যে গবাদি পশু নিয়ে বিবাদ ও দাঙ্গার সৃষ্টি হলে, ইদি আমিন সেখানে আক্ষরিক অর্থে নরবলি চালান। তার এই নিষ্ঠুর দমনকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আখ্যা দিয়ে তৎকালীন উগান্ডার প্রধানমন্ত্রী অ্যাপোলো মিল্টন ওবোতের কাছে তার বিচারের দাবি জানায় তার একসময়কার সমর্থক ব্রিটিশ সামরিক কর্মকর্তারা!
ইতিহাসের নির্মম পরিহাস, একজন হন্তারক, যাকে কিনা ঘৃণা ভরে মানুষ কসাই ডেকেছিল, সেই ইদি আমিনের এত দূর আসা আরো আগেই বন্ধ হতে পারতো। কিন্তু শীঘ্রই ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা পেতে যাওয়া উগান্ডার প্রধানমন্ত্রী ওবোতে হিতে বিপরীত হবার ভয়ে আমিনকে শাস্তি তো দিলেনই না, বরং তাকে ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত করলেন! পরের বছর ১৯৬৩ সালে ইদি আমিন হয়ে গেলেন মেজর। এরপর ব্রিটেনের উইল্টশায়ারের কয়েকটি সেনা ট্রেনিং ক্যাম্পে যোগ দিয়ে আমিন কর্নেল পদে উন্নীত হলেন। সেই থেকে আমিন-ওবোতে বন্ধুত্ব শুরু হয়। এই বন্ধুত্বের ধারাবাহিকতায় ইদি আমিন ১৯৬৬ সালে চিফ অব স্টাফ এবং পরের বছর মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন।
অধিকাংশ সামরিক স্বৈরশাসকেরই ক্ষমতায় আরোহণ ঘটে সামরিক অভ্যুত্থান এর মাধ্যমে। বুচার অব উগান্ডা খ্যাত ইদি আমিন দাদা এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিলেন না। তিনি ওবোতের সাথে বন্ধুত্বের সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজের সামরিক ক্ষমতা ও প্রভাব বৃদ্ধি করতে থাকেন। শুধু তা-ই নয়, তলে তলে তিনি ব্রিটিশ ও ইসরায়েলি গুপ্তচরদের সাথেও হাত মেলান। তবে বিশ্বস্ত বন্ধুর অবিশ্বস্ততার তথ্য চলে যায় ওবোতের কাছে। প্রথমে তিনি আমিনকে গৃহবন্দী করেন। কিন্তু ততদিনে আমিনের বেশ প্রভাব ও সেনাবাহিনীতে একটা সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল। ফলে তাকে গৃহবন্দী রাখা সম্ভব হয়নি। তাই বাধ্য হয়ে ওবোতে আমিনকে মুক্ত করে দেন এবং একটি অ-প্রসাশনিক পদে নিয়োগ করেন। তবে সর্বনাশ যা হবার তা ততদিনে হয়েই গেছে, আমিন কেবল সুযোগ খুঁজছিলেন। অবশেষে সেই সুযোগ এলো ১৯৭১ সালের ২৫ জানুয়ারি। ওবোতে তখন রাষ্ট্রীয় সফরে সিঙ্গাপুর ছিলেন। আমিন এই সুযোগে ক্যু করলেন এবং দেশের ক্ষমতা দখল করে নিলেন। ক্ষমতা দখল করেই নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করে তার দেওয়া প্রথম ভাষণের শুরুতে তার পরিচিতিমূলক প্রথম কয়েকটি লাইন শুনলে যে কেউ বিস্মিত হতে বাধ্য!
আমিনের দুঃশাসনের শুরু
মজার ব্যাপার হচ্ছে প্রাথমিকভাবে ইদি আমিনকে উগান্ডার শাসনব্যবস্থায় স্বাগত জানিয়েছিল উগান্ডার জনগণ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। ক্ষমতায় বসে প্রথমেই আমিন রাষ্ট্রীয় পুলিশ বাহিনী ভেঙে দিলেন এবং নিজস্ব এক কিলার বাহিনী গঠন করলেন। এরপর শুরু হলো ওবোতের সমর্থকদের উপর তার নির্মম অত্যাচার।
বর্ণবাদী দাঙ্গা
ইদি আমিনের ক্ষমতা গ্রহণের পর ওবোতে তানজানিয়াতে পালিয়ে যান। সেখান থেকে ১৯৭২ সালে তিনি নিজের সমর্থকদের নিয়ে একটি ক্যু করার চেষ্টা চালান। তার ক্যুয়ের সমর্থনে উগান্ডার সেনাবাহিনীর একটি অংশ ছাড়াও তানজানিয়ার আচোলি এবং ল্যাঙ্গো সম্প্রদায়ের সামরিক কর্মকতারাও যোগ দেন। কিন্তু ক্যু ব্যর্থ হয়। আমিন সেই সামরিক কর্মকতাদের ঘরবাড়ি বোমা মেরে উড়িয়ে দেন। পাশাপাশি উগান্ডার সেনাবাহিনী থেকে তিনি আচোলি এবং ল্যাঙ্গো সম্প্রদায়ের লোকজনকে ছাঁটাই করতে শুরু করেন। ফলে সেনাবাহিনীর মধ্যে শুরু হয় বর্ণবাদী এক দাঙ্গা, যা ধীরে ধীরে উগান্ডার সাধারণ জনগণের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে।
এই বর্ণবাদী দাঙ্গার সময়ই ইদি আমিনের বীভৎস রূপ প্রকাশ পায়। তিনি নীল নদের তীরের নাইল ম্যানসন এবং হোটেলগুলো সব দখল করে নিজের জিজ্ঞাসাবাদ ও টর্চার সেলে রূপান্তর করেন। দ্রুত সময়ে টর্চার সেলগুলো থেকে রক্তের স্রোত বয়ে যায় নীল নদে। কেবল দাঙ্গা চলাকালীন এই টর্চার সেলগুলোতে ইদি আমিনের অনুগত বাহিনী দশ হাজারের অধিক মানুষ হত্যা করে! এই বাহিনীর দুটি শাখা হচ্ছে স্টেট রিসার্চ ব্যুরো এবং পাবলিক সেফটি ইউনিট। ইদি আমিনের সরাসরি নির্দেশে এ সময় হত্যা করা হয় আর্চবিশপ অব উগান্ডা জানানি লুয়ামকে, উগান্ডার বিচারপতি, ম্যাকারেরে কলেজের উপাচার্য, উগান্ডার রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের গভর্নর সহ ওবোতের অনেক সাবেক মন্ত্রীকে। এ সময় গুপ্তঘাতকের ভয়ে বারবার নিজের বাসস্থান পরিবর্তন করতে থাকেন ইদি আমিন।
বহিরাগতদের বিরুদ্ধে ইদি আমিনের অর্থনৈতিক যুদ্ধ
১৯৭২ সালে ইদি আমিনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো তার দ্য ইকোনমিক ওয়্যার ঘোষণা। তবে এই ঘোষণা ছিল কেবল এশিয়ানদের বিরুদ্ধে। কেননা তখনকার সময়ে উগান্ডার ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সিভিল সার্ভিস উভয় ক্ষেত্রেই প্রধানত এশিয়ানদের দাপট ছিল। বহিরাগতদের মধ্যে একটি বিশাল অংশ আবার ব্রিটিশও ছিল। অন্যদিকে সামরিক বাহিনীর অনেক উচ্চপদে ছিল অনেক ইসরায়েলি। আমিন সামরিক বাহিনী থেকে সকল ইসরায়েলি ছাঁটাই করে দিলেন। এশিয়ান ও ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের তিনি তিন মাসের সময় দিলেন উগান্ডা ছাড়ার জন্য। সিভিল সার্ভিস থেকেও ব্যাপক কাটছাঁট করলেন। আর তাদের ছেড়ে যাওয়া পদগুলো এবং ব্যবসা-বাণিজ্য তিনি নিজের সমর্থকদের মধ্যে বণ্টন করেন। স্বাভাবিকভাবেই ব্রিটিশ আর ইসরায়েলিদের সাথে সম্পর্ক খারাপ হয় ইদি আমিনের। আর এবার তিনি বন্ধুত্ব করলেন রাশিয়া এবং লিবিয়ার সাথে।
জাতীয়তাবাদীদের উত্থান ও আমিনের পতন
আমিনের শাসনামলে ঠিক কত লোক নিহত হয়েছে, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে কোনো সংখ্যা এক লক্ষের নিচে নামেনি। বিরোধী দলের সদস্য থেকে শুরু করে সমর্থক এবং ভিন্নমতের মানুষ, কেউই বাদ যায়নি আমিনের ক্রোধ থেকে; এমনকি যদি তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা একজন স্বনামধন্য ডাক্তার হন, তারপরও। দেশের অর্থনীতি দিন দিন অস্থির হয়ে উঠছিল, তথাপি আমিনের সেদিকে কোনো নজর ছিল না। তিনি দেশের যেকোনো খাতের চেয়ে সামরিক খাতে এবং নিজের সুরক্ষার জন্য বিশেষ বাহিনীর পেছনে বেশি অর্থ ঢালতে থাকেন। ১৯৭৫ সালে উগান্ডার মুদ্রাস্ফীতি দশ বছর আগের তুলনায় এক হাজার গুণে গিয়ে দাঁড়ায়! অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে মানুষের মনে; ধীরে ধীরে নয়, দ্রুত।
১৯৭৮ সালের মধ্যে উগান্ডার পরিস্থিতি একটি গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে গিয়ে দাঁড়ায়। সেনাবাহিনীতে তখন উগান্ডান সৈন্য ছিল মাত্র ২৫ ভাগ, বাকি সবই ছিল অন্যান্য দেশ থেকে ভাড়া করা সৈন্য। ততদিনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছেও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন আমিন। দৃশ্যপট বদলাতে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি অন্যদিকে নিতে আত্মঘাতী এক সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেন ইদি আমিন। তিনি তানজানিয়া আক্রমণ করেন। কিন্তু অর্থাভাবে তার সৈন্যবাহিনীর পর্যাপ্ত রসদ, খাদ্য ও চিকিৎসা কোনোটিই ছিল না। অন্যদিকে তানজানিয়ার সৈন্যবাহিনীর সাথে যোগ দেয় সেখানে নির্বাসিত হওয়া উগান্ডান সৈনিকরা। তাদের মিলিত আক্রমণে দ্রুত পিছু হটে আমিনের অনুগত বাহিনী। বিদ্রোহীরা ১৯৭৮ সালের অক্টোবরের মধ্যে উগান্ডার রাজধানী কাম্পালা দখল করে নেয়। আর স্বৈরাচারী, প্রতাপশালী ইদি আমিন লিবিয়ায় মুয়াম্মার গাদ্দাফির কাছে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ রক্ষা করেন।
লিবিয়ায় দশ বছর কাটানোর পর ১৯৮৯ সালে সৌদি আরবে চলে যান ইদি আমিন। সেখানেই নির্বাসন জীবনে ২০০৩ সালের ১৬ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন
বুচার অব উগান্ডা নামে কুখ্যাত এই একনায়ক।
পুনশ্চ:
স্বৈরাচারী শাসক যত শক্তিশালীই হোক, তার পতন অনিবার্য, তার শেষটা হয় করুণভাবে। বরং নিজের কর্মকাণ্ডের জন্য তারা চিরকাল মানুষের ঘৃণার পাত্র হয়ে থাকেন।

No comments:

Post a Comment

অভিশপ্ত রজনী

  মৃত মেয়েটিকে ধর্ষণ করার সময় মেয়েটি যে জীবিত হয়ে ওঠে সেটা খেয়াল করেনি নেশাগ্রস্ত অবস্থায় কাব্য।ধবধবে সাদা চামড়ার মেয়েটিকে ভোগ করার...