মাথাভাঙ্গা নদী বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। নদীটি বাংলাদেশের কুষ্টিয়া, মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এই নদীটির দৈর্ঘ্য ১২১ কিলোমিটার, প্রস্থ ২৯ মিটার এবং দর্শনার নিকট গভীরতা ১০ মিটার। নদী অববাহিকার আয়তন ৫০০ বর্গকিলোমিটার। সাধারণত এই নদীর তীর উপচে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বন্যা হয় না। নদীটি জোয়ার-ভাটার প্রভাবমুক্ত। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বা ‘পাউবো’ কর্তৃক মাথাভাঙ্গা নদীর প্রদত্ত পরিচিতি নম্বর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদী নং ৭৬।
চুয়াডাঙ্গা জেলার প্রধান নদী পদ্মার দ্বিতীয় বৃহত্তম শাখা মাথাভাঙ্গা । জন্মলগ্ন থেকে মাথাভাঙ্গা ছিল পদ্মার প্রধান শাখা। প্রায় ৪০০ বছর আগে গঙ্গা ভাগিরথী দিয়ে বয়ে যাওয়ার সময় নদীতল বালি পড়ে ভরাট হয়ে গেলে মাথাভাঙ্গা প্রধান স্রোত বয়ে নিয়ে যেত। মাথাভাঙ্গা পশ্চিম বঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার জলঙ্গী শহরের কাছ থেকে গঙ্গা নদীর শাখা হিসাবে মাথাভাঙ্গা নদীর উৎপত্তি। অতীতে এই স্থানটি ছিলো নবগঙ্গা নদীর উৎপত্তিস্থান। নবগঙ্গা নদী গঙ্গার শাখা হিসাবে বেড়িয়ে দক্ষিণমুখী পথে আলমডাঙ্গার কুমারী গ্রামে পৌছালে কুমার নদে বের হয়। কুমার নদ দক্ষিণ পূর্বমুখী পথে আলমডাঙ্গা, শৈলকুপা, শ্রীপুর, মধুখালী, বোয়লমারী, মকসুদপুর, ভাঙ্গা, টেকেরহাট, রাজৈর হয়ে মাদারীপুরের কাছে সাগরের মোহনায় পড়ত। পরবর্তীতে কুষ্টিয়ার তালবাড়ীয়ার কাছ থেকে উৎপন্ন কালিগঙ্গা নদী কুমার নদের প্রবাহ পথকে কোথায়ও গ্রহণ করে কোথায়ও ছিন্ন করে সাগরের দিকে এগিয়ে যায়। করিমগঞ্জের কাছে জলঙ্গীর খাল বা খাড়ি নামে ভৈরব নদের সাথে নবঙ্গার একটি নৌ সংযোগ খাল ছিলো। নবগঙ্গা নদী চুয়াডাঙ্গার উত্তর দিয়ে ঝিনাইদহ, মাগুরা অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হতো। রেনেলের ম্যাপে দেখা যায় নবগঙ্গার শাখা জলঙ্গী নদী দক্ষিণ পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে ভৈরব নদ কে ছিন্ন করে ভাগিরথী নদীতে গিয়ে পড়েছে। গঙ্গার পলিতে নবগঙ্গার মুখ ভরে গেলে কুমার কে সচল রাখার জন্য নবগঙ্গা ও ভৈরব নদের সংযোগ খাল হাউলীর মুখ একবার বন্ধ করা হয়। বন্যায় এই মুখ ভেঙ্গে গেলে মাথা ভাঙ্গা নদীর উৎপত্তি হয়।
অবিভক্ত নদীয়া জেলার প্রধান তিনটি নদীর মধ্য মাথাভাঙ্গা ছিল মুখ্য। মাথাভাঙ্গা নদীয়ার নদী হিসেবেই পরিচিত। এক সময় এ নদী খুব স্রোতস্বিনী ছিল। বহু জনপদ গ্রাস করে মানুষের মাথা ভেঙে দিয়েছিল বলে এর নাম হয়েছে মাথাভাঙ্গা। মতান্তরে, উৎমুখে মূল নদী পদ্মার সঙ্গে সংযোগ নষ্ট হয়ে যাওয়া অর্থাৎ মাথা বা মুখ ভেঙে যাওয়ায় এরূপ নামকরণ করা হয়েছে। তবে কোনো এক সময় এ নদীটি হাউলিয়া বা হাউলি নামে পরিচিত ছিল।
অন্যমতে, যেখানে উৎপত্তি লাভ করেছে, সে স্থানেই নদীটি খুব ভাঙ্গনপ্রবণ। অর্থাৎ নদীর মাথা ভাঙনপ্রবণ বলে নাম হয়েছিলো মাথাভাঙ্গা। মাথাভাঙ্গা নদীর শাখা নদীগুলোও এক সময় খুবই ভঙ্গনপ্রবণ ছিলো।
ড. থমাস ওল্ডহ্যাম ১৮৭০ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির কার্যবিবরণীতে উল্লেখ করেছেন ভাগিরথী ও ভৈরবের মধ্যবর্তী জায়গা কালক্রমে নদীবাহিত পলি মাটি দিয়ে ভরাট হয়ে যায়। ফলে গতিমাত্রা আরো কমে গেলে পদ্মা পূর্ব দিকে সরে যায় এবং মাথাভাঙ্গার আবির্ভাব ঘটে। তবে বিখ্যাত সেচ বিশেষজ্ঞ উইলিয়াম উইলকক্রের মতে, মাথাভাঙ্গা সেচের জন্য কাটা খাল ছাড়া কিছুই নয়। তবে ১৮৬২ সালে রেলপথ চালু হওয়ার আগে মাথাভাঙ্গা নদীপথেই কলকাতার সঙ্গে এ অঞ্চলের যোগাযোগ ছিল।
মাথাভাঙ্গা নদী বলতে বর্তমান জলঙ্গীর কাছে নবগঙ্গা নদীর আদি উৎসমুখ থেকে উৎপন্ন হয়ে দক্ষিণে আলমডাঙ্গা চুয়াডাঙ্গা ও দর্শনা পথে প্রবাহিত নদীকে বোঝায়। মাথাভাঙ্গা নদী জলঙ্গী থেকে চুয়াডাঙ্গা পর্যন্ত নবগঙ্গা নদীর উপর, চুয়াডাঙ্গা থেকে শাবুলপুর পর্যন্ত হাউলী নদীর উপর এবং শাবুলপুর থেকে দর্শনা পর্যন্ত ভৈরব নদের উপর দিয়ে বয়ে চলেছে। ভৈরবের শাখা ইছামতী। ভরতের মাজদিয়ার কাছ থেকে ইছামতী নদীর শাখা চূর্ণী বের হয়েছে যা দক্ষিণপশ্চিম পথে ভাগিরথীতে পরেছে। সীমান্ত নদী মাথা ভাঙ্গা কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার চিলমারী ইউনিয়নে প্রবেশ করে প্রায় ১৫ কিলোমিটার ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত ধরে দক্ষিণে এগিয়েছে। কাজীপুরের কাছে বাংলাদেশে প্রবেশ করে প্রায় ৭০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ভৈরবের সাথে গিয়ে মিলেছে। এরপর পায় ২৫ কিলোমিটার পথ গিয়ে মাথাভাঙ্গা নদী ভারতে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশে প্রবেশের মুখে ডান দিকে গাংনি উপজেলার মাতমুরা নামে একটি পানির স্তর থেকে পানি পেয়ে ও খলিশাকুন্তির কাছে হিসনা ও ঝাঁ ঝা নদীর প্রবাহ পেয়ে। সারা বছর চালু থাকে। এই ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের সাথে গাঙ্গ নদীর সংযোগ আছে। মাথাভাঙ্গা নদী তার প্রবাহপথে গাংনী উপজেলার কিছু এলাকায় বৃষ্টির পানিও পায়।
বর্ষাকালে মাথাভাঙ্গা নদী গঙ্গা নদী থেকে বন্যার পানি পায়। কিন্তু এই নদীর পুরো প্রবাহ সারাবছর দর্শনার ভাটিতে ভারতে চলে যায়। মাথাভাঙ্গা নদীর সাথে কাজলা নদীর মাধ্যমে স্টুয়ার্ড খাল নামে নৌসংযোগ খাল ছিলো। খলিশাকুন্ডির দক্ষিণে এর একটি লুপকাট আছে। দর্শনার আগে এর ডান তীরে দামুরহুদা উপজেলার কুড়লগাছি ইউনিয়ন থেকে রাইসা বীলের খাল এস পড়েছে। দর্শনারে ভাটিতে একই উপজেলার মদনা ইউনিয়ন এলাকার দামোদর বিলের খাল এসে পড়েছে। দামুরহুদা উপজেলার দক্ষিণ সীমানায় দাড়ি নামে একটি নদী আছে যা দামোদর বিলের সাথে সংযুক্ত। চুয়াডাঙ্গা ও দর্শনার মাথাভাঙ্গা নদীর পানি সমতা মাপার স্টেশন আছে।
১৭৭১ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মিস্টার রেনেলকে নদী জরিপ কাজে নিযুক্ত করে। ১৭৮০ সালে রেনেলের মানচিত্র প্রকাশিত হয়। এতে গ্রীষ্মকালে মাথাভাঙ্গায় বড় নৌকা চলাচলে বিঘ্ন ঘটে বলে উল্লেখ করা হয়। ১৭৯৫ সালে মাথাভাঙ্গা নদী জরিপ শেষে সংস্কার করে নৌ-বাণিজ্যের উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়। ১৭৯৭ সালে পলি অবক্ষয়ের কারণে মাথাভাঙ্গার গভীরতা কমে যায়। ১৮১৩ সালে সরকার মাথাভাঙ্গা সংস্কারের জন্য কর ধার্য করে। ১৮১৯-২০ সালে জি কে রবিনসনকে মাথাভাঙ্গার প্রধান তত্ত্বাবধায়ক ও কালেক্টর নিয়োগ করা হয়। অপরদিকে মাথাভাঙ্গার বিপদ হয়ে দেখা দেয় তারই শাখা নদী কুমার। মাথাভাঙ্গার স্রোতের ৫ ভাগের ৪ ভাগ পানিই কুমার নদী দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় মাথাভাঙ্গার বিপদ ত্বরান্বিত হয়ে পড়ে।
১৮২৩ সালে প্রথমবারের মতো বঙ্গদেশে ১০ দশমিক ৪০০ পাউন্ড ব্যয়ে গরুচালিত ড্রেজিং মেশিন আনা হয়। কিন্তু সে বছর হঠাৎ মাথাভাঙ্গার গতি পরিবর্তন ঘটে। পরে ১৮৮১ সালে মাথাভাঙ্গা হঠাৎ নাব্য হয়ে ওঠে। এতে পরিষ্কার এতদঞ্চলের নদীর নব্য গঙ্গা ও পদ্মার প্রবাহের ওপর নির্ভরশীল। বর্তমানে মাথাভাঙ্গা একটি বড় খালের আকারে তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। অথচ ১৯৭১ সালেও উপজেলার দর্শনা পয়েন্টে মাথাভাঙ্গা পানিপ্রবাহের সর্বোচ্চ রেকড ছিল ১২ হাজার ৯০০ কিউসেক।
বিশ্ববিখ্যাত ব্রিটিশ পানি প্রকৌশলী বিজ্ঞানী উইলিয়াম উইকক্স, ফারাক্কার পরিবর্তে মাথাভাঙ্গা নদীর উৎসস্থানের পরে নদীয়া জেলার সীমান্তে বাঁধ নির্মাণের সুপারিশ করে বলেছিলেন, ‘নদীয়ায় বাঁধ নির্মিত হলে গঙার পানি সারা বছরই একটি হিসাবের মধ্যে প্রবাহিত হতো। বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের জন্যই মঙ্গলজনক হতো’।
No comments:
Post a Comment