প্রসঙ্গঃ ঘাতক গেইম Blue whale
Blue whale গেইমটির কথা বহুদিন যাবত শোনা গেলেও এ নিয়ে কারও তেমন
মাথাব্যাথা ছিল না। কিন্তু সম্প্রতি ঢাকার নিউ মার্কেট থানা এলাকার অপূর্বা
বর্ধন স্বর্ণা নামের ১৩ বছর বয়সী এক কিশোরীর আত্মহত্যা দেশবাসীকে আতংকের
মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
মৃত কিশোরীর বাবা জানিয়েছেন, ইন্টারনেটভিত্তিক
ডেথ গেমস নীল তিমির কবলে পড়ে স্বর্ণা আত্মহত্যা করেছে। মেয়ের লিখে যাওয়া
একটা চিরকূট থেকে এমন তথ্য মিলেছে।
তিনি আরও জানান, নীল তিমির
কিউরেটরের নির্দেশ মতো লিখে যাওয়া একটি চিরকুট পাওয়া গেছে। যেখানে লেখা,
আমার আত্মহত্যার জন্য কেউ দায়ী নয়। এছাড়া গেমসের নির্দেশনা মতো একটি হাসির
চিহ্নও আঁকা ছিল।
বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে
জানা গেছে, আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতেও এই গেইমটি মুর্তিমান আতঙ্ক হয়ে
দেয়া দিয়েছে। আর সঙ্গতঃকারণেই আমাদেরও মাথাব্যাথার যথেষ্ট কারণ দেখা
দিয়েছে।
এটি ডার্ক ওয়েবের একটি গেম। আমরা যে ইন্টারনেট পোর্টাল ইউজ
করি সেটির নাম “world wide web” এবং গুগল, ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, টুইটার
ইত্যাদি এসবই কিন্তু “world wide web” এরই একটি অংশ। আর আমাদের এই
ইন্টারনেট জগতের বাইরে আরও একটি বিশাল জগত রয়েছে যার নাম “dark web”.
“dark web” সম্পুর্নরূপে একটি অন্ধকার জগত এবং বিভিন্ন ক্ষতিকর, অবৈধ ও
খারাপ কাজের জন্যই এটি বিখ্যাত। এর ওয়েব সাইট গুলো সাধারণত খারাপ কাজের
উদ্দেশ্যেই তৈরি হয়ে থাকে।
ডার্ক ওয়েব থেকে ডাউনলোড করে facebook, twitter, instagram কিংবা vk.com
এ এর লিংক গুলো শেয়ার করা হয়। বিভিন্ন প্রকার মজা ও সারপ্রাইজের কথা বলে
গেইমটি ডাউনলোড করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়। আর একবার এই গেইম ইনস্টল করলে গেইমটি
শেষ না করা পর্যন্ত আনইনস্টল করার আর কোনো উপায় থাকে না। ইন্সটল হয়ে গেলেই
এর মাধ্যমে গেমের টিম আপনার ip location সহ সকল প্রকার পার্সনাল ইনফরমেশন
ট্রাক করতে শুরু করবে এবং আপনাকে বাধ্য করবে গেমটি খেলতে।
সমাজকে
“সাফ” করার জন্য ২০১৩ সালে রাশিয়ার ফিলিপ বুদেকিন নামে বিশ্ববিদ্যালয়
থেকে বিতাড়িত এক মনোবিজ্ঞানের ছাত্র এই গেইমটি তৈরী করেছিল।
কি আছে এই গেমে?
এটি একটি চ্যালেঞ্জিং গেম এবং এর ৫০ টি চ্যালেঞ্জ লেভেল বা স্তর রয়েছে।
গেমটির প্রতিটি লেভেল পুরণের আগে ও পরে গেমের টিম মেম্বাররা প্লেয়ারদের
সাথে যোগাযোগ করে এবং পূর্ববর্তী লেভেল সঠিকভাবে সম্পুর্ন করতে পারলেই তাকে
পরবর্তী লেভেল খেলার সুযোগ দেয়।
গেমটির প্রথম ১০ টি লেভেল খুবই
সহজ, আকর্ষনীয় ও চমকপ্রদ। শুরুতে খুবই মনভোলানো কথাবার্তা, মজার টিপস এবং
ছোট ছোট চ্যালেঞ্জ দিয়ে যে কাওকেই আপন করে নেয়। তবে এর আকর্ষন করার ক্ষমতা
এতটাই প্রবল যে, যারাই এই গেমটি খেলেছে, তাদের সবাই এর প্রথম ১০ লেভেল
খেলার পর এটিকে তাদের নিজের জীবনের একটি অংশ বানিয়ে ফেলেছিল।
প্রথম
১০টি চ্যালেঞ্জ কমপ্লিট হওয়ার পর গেমারকে পরবর্তী ১০ লেভেল খেলার জন্য
তৈরী করা হয়। যেহেতু টিনএজরা কল্পণাপ্রবণ হয়ে থাকে, সেহেতু এই লেভেলগুলোতে
বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে প্রচুর কল্পনা করানো হয়। আর এই পর্বেও চলতে থাকে
ছলে, বলে কৌশলে তাদের পার্সোনাল ইনফরমেশন হাতিয়ে নেওয়ার কাজ। আর একজন
প্লেয়ার নিজের অজান্তেই তাদেরকে সব তথ্য দিতে থাকে।
এই পর্বে ১৫
লেভেলের পর গেমারকে একটি নীল তিমির একটি ছবি আঁকতে শেখানো হয় এবং পরবর্তী
কোন এক লেভেলে ব্লেড দিয়ে হাত কেটে উক্ত ছবিটি আঁকতে বলা হয়। বলা হয় যে,
ব্লেড অথবা সুচ দিয়ে তোমার হাতে একটি ব্লু হোয়েলের (নীল তিমির) ছবি আঁক,
কিন্তু সাবধান এর ক্ষত যেন বেশি গভীর না হয়। আর এভাবেই শেষ হয় আরও দশটি
লেভেল ।
২১-৩০ নং লেভেলে গেমার টিম তাদের কৌশল পাল্টে ফেলে। কারণ
ইতিমধ্যেই তারা একজন গেমারের ছোট-খাটো সকল তথ্য ও পার্সনাল ইনফরমেশন নিয়ে
নেয়। এবং এর পরই তারা গেমারকে বেশ কিছু কঠিন চ্যালেঞ্জের দিকে এগিয়ে নিয়ে
যায়। যেমন, ঠান্ডার রাতে একটা হালকা ড্রেস পরে সারারাত জেগে থাকা এবং
সারাদিন না খয়ে থাকা, পরিবারের সাথে ঝগড়া করা এবং বাড়ি থেকে টাকা চুড়ি করা,
ঘনিষ্ট বন্ধু-বান্ধবের একান্তই কিছু ব্যক্তিগত জিনিস চুরি করা এবং প্রমাণ
হিসেবে সেগুলোর একটি করে ফটো আপলোড দেওয়া ইত্যাদি। ২৫ লেভেলের পর গেমারকে
বিভিন্ন ড্রাগ নিতে অভ্যাস্ত করা হয় এবং খুব সুক্ষ্নভাবে কৌশল করে লেভেল ৩০
পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যায়।
৩০ টি লেভেল কমপ্লিট করে একজন গেমারের
অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়ায় যে, সে পরবর্তী চ্যালেঞ্জ পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে
উঠেিএবং এর জন্য সে যেকোন কিছু করতে প্রস্তুত থাকে। আর তারা এটাকেই সুযোগ
হিসেবে কাজে লাগিয়ে গেমের ৩১ নং চ্যালেঞ্জ আনলক করে দেয় যাতে বলা হয়, তুমি
নগ্ন পোজে বেশকিছু ফটো তুলে আমাদের কাছে আপলোড করো। গেমার তখন ড্রাগের
কারণে হোক অথবা হিপন্সিস জনিত কারণেই হোক, নিজের নগ্ন ফটো আপলোড দিতেও
দ্বিধাবোধ করে না। আর এভাবেই গেমটি তাকে পরবর্তী লেভেলগুলোতে বাধ্য করে অতি
ভারিমাত্রার ড্রাগ নিতে, কারও সাথে সেক্স করে তার ফটো আপলোড দিতে আর
গেমটির ৪০ নং চ্যালেঞ্জে বলা হয় যে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় অন্তত পক্ষে ২৫
থেকে ৩০ টা সুচ প্রবেশ করিয়ে তার একটি ফটো আমাদের কাছে সেন্ড করো।
৪০ টি চ্যালেঞ্জ কমপ্লিট হওয়ার পর গেমার এতটাই মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত ও
ভীত হয়ে পড়ে যে, সে বার বার ব্লু হোয়েল টিমকে রিকোয়েষ্ট করতে থাকে, সে আর
এই গেমটি খেলতে চায় না, সে আর চাপ নিতে পারছে না, তাকে ছেড়ে দেওয়া হোক।
কিন্তু ব্লু হোয়েল টিম তাকে আরও বেশি চাপ প্রয়োগ করতে তাকে ব্লাকমেইল করা
শুরু করে। বলে যে, তুমি যদি পরবর্তি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ না কর, তাহলে তোমার
নগ্ন ফটোগুলো তোমার ফেসবুকে পোষ্ট করে দেওয়া হবে, তোমার ড্রাগ নেওয়ার সকল
প্রমান পুলিশকে দিয়ে দেওয়া হবে, তোমার সেক্স করার ফটোগুলো তোমার বাবা-মায়ের
কাছে প্রকাশ করে দেওয়া হবে, ফ্রেন্ডদের ব্যক্তিগত জিনিস ও বাড়িতে টাকা
চুড়ির ঘটনাগুলোও প্রকাশ করে দেওয়া হবে। তাদের এই ধরণের কথা শুনে গেমার আরও
বেশি আতংকিত হয়ে পড়ে এবং অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাধ্য হয় পরবর্তি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ
করতে। সুতরাং আবার তাক বাধ্য করা হয় শরীরে ব্লেড কিংবা ছুরি চালাতে এবং
ভারি মাত্রার ড্রাগ নিতে। গেমার যখন আর এ সব চাপ নিতে পারে না তখন সে আপন
মনেই আত্নহনের পথ বেছে নেয়। গেমটির ৫০ নম্বর চ্যালেঞ্জে বলা হয়, এটি
সর্বশেষ চ্যালেঞ্জ, এর পর আমরা তোমাকে আর কোনভাবে বিরক্ত করব না। এই
চ্যালেঞ্জে তোমাকে আমাদের দেখানো নির্দেশনা অনুযায়ী শেষবারের মত একটি ড্রাগ
সংগ্রহ করতে হবে। এটি নিয়ে কোন একটি উচু বিল্ডিং এর ছাদে উঠতে হবে এবং
একেবারে কিণারায় দাঁড়িয়ে এটি তোমার শরীরে পুশ করতে হবে এবং প্রমানস্বরূপ এর
একটি সেলফি তুলে আমাদেরকে দিতে হবে, যাতে করে আমরা বুঝতে পারি যে, তুমি
সকল নির্দশনা গুলো সঠিকভাবে পুরণ করেছ আর এরপরই তোমাকে সকল পার্সোনাল
ইনফরমেশন ফিরিয়ে দেওয়া হবে, তুমি গেমটিকে আনইন্সটল করতে পারবে এবং তুমি সেফ
থাকবে। গেমার এই কাজটি করে ফেললে তাকে বলা হয়,
”তুমি এই গেমের সকল
লেভেল সম্পুর্ন করেছ এবং তোমাকে আমাদের আর দরকার নেই, তাই আজ থেকে তুমি
মুক্ত। নিচে তাকিয়ে দেখ তোমার গন্ত্যব্য তোমাকে ডাকছে, সূতরাং,
বেশি
দেরি করো না, এক্ষনি ঝাঁপ দাও। আর গেমার তখন ড্রাগ অ্যাফেক্টেড থাকার কারণে
সম্পুর্ন হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে এবং বুঝতে পারে না যে, তাকে কি করতে
হবে। প্রচন্ড ঘু্মের চাপে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসে, সে চারদিকে ঝাপসা দেখতে
শুরু করে। নিজের অজান্তেই সে সত্যি সত্যিই ঝাঁপ দিয়ে বসে এবং নিজের মুক্তির
পথ খুজে নেয়। আর ব্লু হোয়েলও খুজতে থাকে তার পরবর্তী শিকারকে।
------------------------------------------------------------------------------------------------------
এই হলো ব্লু হোয়েল। আমরা জানি না স্বর্ণার মতো আমাদের কতো কিশোর ও তরুণ
সন্তান এই ঘাতক গেইমে আসক্ত। আমরা চাই না আমাদের আর একটি সন্তানও এমন
করুণভাবে মৃত্যুবরণ করুক। তাই সকল পিতা-মাতার প্রতি বিনীত অনুরোধ -
সন্তানকে ভালোবাসুন। তার মঙ্গল ও নিরাপত্তার স্বার্থেই ক্ষেত্রবিশেষে একটু
কঠোর হউন। সন্তানের সব আবদার মেনে নেবেন না। তার প্রতি লক্ষ্য রাখুন। তার
মানসিক ও আচরণগত যে কোনো ধরণের পরিবর্তন বিচক্ষণতার সাথে লক্ষ্য রাখুন।
শুধু ব্লু হোয়েল নয়, এমন আরও অনেক ঘাতক গেইম আছে। তাই যেকোনো লিংকে লগ-ইন
থেকে বিরত থাকুন। কলটি রিসিভ করার আগে নম্বরটি ভালো করে দেখে নিন।
সন্দেহজনক যে কোনো নম্বর এড়িয়ে চলুন।
No comments:
Post a Comment